ইন্টারনেট | প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

সুহাদা আফরিন: বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩৯ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এই হার পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। তবে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ প্রতিবেশী এবং সমপর্যায়ের অর্থনীতির বিভিন্ন দেশের তুলনায় কম। এর মানে হলো, ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে।

বিশ্বব্যাংকের ‘ডিজিটাল অগ্রগতি ও প্রবণতা প্রতিবেদন ২০২৩’–এ এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি গত মাসে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসা ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহারসহ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন সূচকে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার নয়, স্মার্টফোন ব্যবহার, ইন্টারনেটের গতি, ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের বিভিন্ন দেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদিক দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা ফোরজির আওতা, ইন্টারনেটের দাম ও ডিজিটাল লেনদেনের দিক থেকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ২২৫টির মতো দেশ ও অঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার মিয়ানমারের চেয়েও কম। মিয়ানমারে জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের শ্রেণিভুক্ত। এই শ্রেণিভুক্ত দেশগুলোতে গড়ে জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে হার ৪২ শতাংশ। মানে হলো, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার গড় হারের চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

ইন্টারনেট ব্যবহারের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে বিশ্বব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) ২০২২ সালের উপাত্ত ব্যবহার করেছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যগুলো যেহেতু ২০২২ সাল পর্যন্ত, সে ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য থাকতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ইন্টারনেট ব্যবহারে এগিয়ে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। তিনি বলেন, সরকার চেষ্টা করছে আরও এগিয়ে যেতে।

বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস প্রতিবেদন–২০২৩ বলছে, এখন দেশের পাঁচ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এই উপাত্ত বিবেচনায় নিলেও দেখা যায়, বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।

স্মার্টফোন ব্যবহার
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার প্রায় ৫২ শতাংশ। হারটি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। আফগানিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে (৫৬ শতাংশ)।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপে ৮৩, ভুটানে ৮১, ভারতে ৭৭, শ্রীলঙ্কায় ৭০, পাকিস্তানে ৬৩ ও নেপালে ৫৯ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারী স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশের মানুষ কেন স্মার্টফোন ব্যবহার কম করেন, তা উঠে এসেছিল ‘ব্রডব্যান্ড কমিশন’ নামের একটি প্রতিবেদনে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ওই প্রতিবেদনে জিএসএমের (মোবাইল অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন) তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়, মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনই মনে করেন না এবং সামর্থ্য না থাকায় ব্যবহার করেন না ১১ শতাংশ। সুযোগ না থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না এমন মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তার কারণে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশে মুঠোফোন ইন্টারনেটে ডাউনলোডের গতি ১৬ দশমিক ১ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড)। ব্রডব্যান্ডে তা ৩৬ এমবিপিএস। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার গড়ে গতি যথাক্রমে ২৬ দশমিক ৭ ও ৪৩ এমবিপিএস। বাংলাদেশে মাথাপিছু মাসে গড়ে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ডেটা ব্যবহারের হার ৩ দশমিক ২ জিবি (গিগাবাইট); যা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম। যদিও মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ইন্টারনেটের দাম বাংলাদেশে মোটামুটি কম।

বাংলাদেশে এক মাস মেয়াদি দুই জিবি মোবাইল ইন্টারনেট ডেটার দাম মাসিক মাথাপিছু আয়ের ১ শতাংশের সমান। এটা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের (১ দশমিক ২ শতাংশ) চেয়ে কম।

দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়াতে দাম কমানোর ওপর জোর দিয়ে আসছে। তারা বলছে, এ দেশে স্মার্টফোনের দাম বেশি। এটা কমাতে না পারলে ব্যবহার বাড়বে না।

দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান  বলেন, দেশে সাধারণভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ততটা বাড়ছে না; তাই ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত।

ব্যবসায় ইন্টারনেট
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিশ্বের ৪টি অঞ্চলের ১৪টি দেশের ওপর ব্যবসার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে কম্পিউটার ব্যবহারবিষয়ক একটি তথ্যচিত্র দেওয়া হয়েছে; যেখানে ভিয়েতনাম, চিলি, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, জর্জিয়া, ভারত, কেনিয়া, কম্বোডিয়া, ঘানা, ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসোর পরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে সেনেগাল।

ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে তথ্যচিত্রেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। তবে এ দেশের পেছনে রয়েছে ঘানা, ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসো ও সেনেগাল। বাংলাদেশের ১০ শতাংশের কম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসার জন্য ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবহার করে। বাংলাদেশের ১৫ বছরের বেশি বয়সী ৪৫ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল লেনদেন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে গড় হার ৩৩ শতাংশ।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পণ্য উৎপাদন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখছে, সেই তথ্য বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে নেই। তবে বলা হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তিসেবা খাত দেশের অর্থনীতিতে ৪৫২ কোটি ডলার অবদান রাখছে, যদিও দক্ষিণ এশিয়ার গড় হিসাবে তা কম। তথ্যপ্রযুক্তিসেবা রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশে ২২ হাজার এবং সেবাদানে ১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এটাও দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তুলনায় কম। 

‘ডিজিটাল বৈষম্য বাড়ছে’
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। দেশকে ডিজিটাল করতে নেওয়া হয় নানা প্রকল্প। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মতো অন্য দেশগুলো কিন্তু ঘোষণা দিয়ে ডিজিটাল দেশ গড়ার মতো লক্ষ্য ঠিক করেনি; কিন্তু এর পরও তারা এগিয়ে আছে। তিনি বলেন, সরকারের সব সেবা এখন ডিজিটাল হয়েছে; কিন্তু ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারে দেশের অর্ধেক মানুষ নেই। তাঁরা তো সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থাৎ দেশে ডিজিটাল বৈষম্য বাড়ছে।