হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে রোববার সকালে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি সুনামগঞ্জ: হাওরে বৈশাখ আসে নতুন ফসলের সুবাসে, কিষান-কিষানির নির্মল হাসিতে। এবারও তা–ই হয়েছে। গত সপ্তাহে ঝড়বৃষ্টিতে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, সেটি কেটে গেছে। হাওরের পুবালি হাওয়ায় এখন সোনালি ধানের সুবাস। ধান পেকেছে। নতুন বছরে, নতুন আশা নিয়ে সেই ধান কাটতে শুরু করেছেন কৃষকেরা।
কৃষি বিভাগের ভাষ্য, এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। নির্বিঘ্নে হাওরের ফসল গোলায় তুলতে পারলে এবার সুনামগঞ্জে ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকার ধান উৎপাদিত হবে।
সুনামগঞ্জের হাওরে বৈশাখজুড়ে অন্য রকম এক উৎসব চলে। এটি কৃষকের শ্রমে-ঘামে জমিতে ফলানো সোনার ধান গোলায় তোলার উৎসব। এই উৎসবে কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই যোগ দেন। এমনকি গ্রামের বাইরে থাকা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও ছুটে আসেন পরিবারের অন্যদের সহযোগিতা করতে। এই ধানের ওপরই পুরো পরিবারের এক বছরের খাবার, সব ব্যয়, বিয়েশাদি ও সন্তানদের লেখাপড়া নির্ভর করে। এই ধান তুলতে পারলেই হাওরপাড়ের কৃষকেরা ‘ধনী’। কোনো কারণে গোলায় ধান না উঠলে হাওরে বেদনা ভর করে। কৃষক পরিবারে কষ্টের সীমা থাকে না।
বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, সব সময় যে তাঁরা এই ধান গোলায় তুলতে পারেন, এমন না। ২০১৭ সালের হাওর-বিপর্যয়ের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সে বছর হাওর থেকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল তাঁদের। গত বছর নির্বিঘ্নে ধান গোলায় তুলেছেন। এর আগের বছর অন্তত ২০টি হাওরে ফসলহানি হয়েছিল।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সময়টায় সুনামগঞ্জে ও জেলার উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। উজানে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নেমে আগাম বন্যা দেখা দেয় হাওরে। ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে কিংবা বাঁধ উপচে হাওরের ফসল তলিয়ে ফেলে।
এবারও মার্চের শেষ সপ্তাহ এবং এপ্রিলের শুরুতে ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় সবার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কয়েকটি হাওরে বেশ কিছু ধান নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ওই সব জমির কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কিন্তু গত তিন দিন বৃষ্টি না হওয়ায় তাঁদের মনে স্বস্তি ফিরেছে। হাওরে এখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। তবে এবার হাওরে বৃষ্টির পানি থাকায় মেশিন দিয়ে ধান কাটাতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরপাড়ের মুক্তিখলা গ্রামের কৃষক আবদুল গণি বলেন, একসময় হাওরে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আসতেন। এখন এটা একবারে কমে গেছে। স্থানীয়ভাবেও শ্রমিক মেলে না। তাই এখন ধান কাটার যন্ত্রের ওপরই ভরসা। কিন্তু হাওরে পানি থাকলে মেশিনে ধান কাটায় সমস্যা হয়।
সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের কৃষক আরব আলী বলেন, তিনি এবার দেখার হাওরে ১০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। ধান কাটা শুরু করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে ১০ দিনে সব তুলে ফেলবেন। একই গ্রামের আরেক কৃষক মহিনুর ইসলাম বলেন, পুরোদমে ধান কাটা শুরু হতে আরও তিন থেকে চার দিন সময় লাগবে। রোদ ওঠায় সবাই খুশি। এভাবে ১৫ থেকে ২০টা দিন পেলেই হবে।
পুরো বৈশাখ হাওরে কাটে কৃষক পরিবারের লোকজনের। ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানো—সবই চলে হাওরে। এ জন্য হাওরে উঁচু জায়গায় ‘খলা’ তৈরি করা হয়। আবার কোনো কোনো হাওরপাড়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে পুরো পরিবারসহ সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে যান কেউ কেউ। তাঁদের বলে ‘জিরাতি’। সুনামগঞ্জের বড় বড় হাওরে জিরাতিরা থাকেন। সদর উপজেলার নীলপুর গ্রামের কৃষক আনফর আলী বলেন, ‘দিন ভালা, আমরা খুশি। এই ধানই আমরার সব। ধান পাইলে সুখী, না পাইলে ফকির।’
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরে বোরো ধানের আবাদ হয়। এবার জেলার হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। জেলায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য ৮৫০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর আছে। মেশিনে ৫৫ ভাগ এবং শ্রমিকেরা ৪৫ ভাগ জমির ধান কাটবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি ভালো। এখন পর্যন্ত ৩ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে।
সুনামগঞ্জে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতিবছর প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ৪০টি হাওরে ফসল রক্ষায় বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ করে। এবার জেলার ১২টি উপজেলায় ৭৩৫টি প্রকল্পে ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে। এতে প্রাক্কলন ধরা আছে ১৩০ কোটি টাকা। ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। পরে সময় আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়।
পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ভারী বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস নেই। এ সময় সুনামগঞ্জে ও উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, ঝড়বৃষ্টিতে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল, সেটা কেটে গেছে। কৃষকেরা যাতে হাওরের ফসল নির্বিঘ্নে গোলায় তুলতে পারেন, এ জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করা হবে।