ডিসমিসল্যাব ৫৮টি ইউটিউব চ্যানেল পেয়েছে, যা নকল | প্রতীকী ছবি: রয়টার্স |
রাজীব আহমেদ: ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি যাঁরা নিয়মিত দেখেন, তাঁদের কাছে পরিচিত মুখ হিউ এডওয়ার্ডস। তিনি সাংবাদিক ও উপস্থাপক। ‘বিবিসি নিউজ অ্যাট টেন’ শিরোনামের অনুষ্ঠানের প্রধান উপস্থাপক ছিলেন তিনি।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে যৌন অসদাচরণের দায়ে বিবিসি কর্তৃপক্ষ হিউকে বরখাস্ত করে। গত জানুয়ারিতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, হিউ বিষণ্নতায় ভুগছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অবশ্য সাত দিন আগে ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ বাংলা’ শিরোনামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, হিউ এডওয়ার্ডস বাংলায় খবর পড়ছেন। তিনি বলছেন, ‘বিবিসি আন্তর্জাতিক খবরে আপনাকে স্বাগত। শুরুতেই শিরোনাম। পরে বিস্তারিত।’
পাঠক, বিভ্রান্ত হবেন না। হিউ এডওয়ার্ডস কোনো বাংলা ইউটিউব চ্যানেলের চাকরিতে যোগ দেননি। বরং তাঁর ছবি ব্যবহার করে, সেখানে আরেকজনের কণ্ঠ বসিয়ে নকল ভিডিও চিত্র তৈরি করেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ বাংলা নামের ইউটিউব চ্যানেলটি। এই চ্যানেল বিবিসির লোগোর আদলে তৈরি।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের (ডিআরএল) তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব এমন ৫৮টি ইউটিউব চ্যানেল খুঁজে বের করেছে, যেগুলো বিদেশি ও বাংলাদেশি সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমের কার্যত নকল। চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের দর্শকদের লক্ষ্য করে খবর প্রচার করে। কেউ সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমের নামের আদলে নিজেদের নাম দিয়েছে, কেউ লোগো নকল করেছে, কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের সুপরিচিত উপস্থাপকের ছবি ব্যবহার করে ভিডিও ছাড়ছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন বলছে, নকল ইউটিউব চ্যানেলগুলোর মূল কাজ হলো নিজেদের প্রচার (ভিউ) বাড়ানো এবং এর মাধ্যমে আয় করা। তবে তারা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায়। ভিডিও প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় সংবেদনশীল বিষয়গুলো। যেমন বিবিসি-নিউজ বিডি নামের একটি চ্যানেলে গত ৩ জানুয়ারি খবর (ভিডিওর থাম্বনেইলে) দেওয়া হয় যে, ‘নির্বাচনে সেনাবাহিনীর থাবা, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল ঘোষণা’। যদিও খবরটি ভুয়া।
ডিসমিসল্যাব বলছে, যেহেতু তারা সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমের নকল, সেহেতু পাঠক বিভ্রান্ত হয়। আবার এসব চ্যানেলে প্রচারিত ভুয়া ও চটকদার খবরের কারণে সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলো দর্শক থেকে বঞ্চিত হয়। গবেষকেরা সংবাদসংশ্লিষ্ট কিছু শব্দ দিয়ে ইউটিউবে খোঁজ (সার্চ) করে দেখেছেন, যেসব প্রতিবেদন সামনে আসে, তার অর্ধেকই এসব নকল চ্যানেলের।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুনের মতামত নেওয়া হয়। তিনি বলেন, সংবেদনশীল সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের লোগো ব্যবহার করে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের গড় গণমাধ্যম-জ্ঞান (মিডিয়া লিটারেসি) ততটা বেশি নয়। আমরা যা দেখি, যাকে দেখি, তা যাচাই করি না। এরপর এমন হতে পারে যে মানুষ একপর্যায়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে ওগুলো (অপতথ্য) সত্য।’
নকলের শিকার কারা
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অনেকেই খবরের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারবিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ডেটা রিপোর্টাল নামের একটি ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে চলতি বছরের শুরুতে ইউটিউব ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৩৬ লাখের মতো।
ইউটিউব চ্যানেল হলো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খোলা চ্যানেল, যেগুলোতে ভিডিও প্রচার করা যায়। চ্যানেলগুলোয় বিজ্ঞাপন প্রচারের বিপরীতে আয়ের ভাগ দেওয়া হয় চ্যানেলমালিকদের। বাংলাদেশের অনেকেই ইউটিউবে সৃজনশীল ও নিজেদের তৈরি ভিডিও প্রচার করে বড় অঙ্কের অর্থ আয় করেন। অন্যদিকে অনেকেই জনপ্রিয় চ্যানেলের নকল করে অপ ও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন।
ডিসমিসল্যাব জানাচ্ছে, যে ৫৮টি চ্যানেল তারা খুঁজে পেয়েছে, তার মধ্যে ৩৭টিই বিবিসিকে নকল করেছে। নকলের শিকার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএনএন ও এবিসি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়টার্স, কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা এবং বাংলাদেশের সময় টেলিভিশন, একাত্তর টেলিভিশন, যমুনা টেলিভিশনের মতো সংবাদমাধ্যমগুলো। যেমন একটি চ্যানেলের নাম আল-জাজিরা বাংলা। ডিসমিসল্যাব বলছে, এই নামে আল-জাজিরার কোনো চ্যানেল নেই। এটি আসলে আল-জাজিরার লোগো নকল করে তৈরি করা চ্যানেল।
বিবিসিকে নকল করা ১২টি চ্যানেলের ১৬৮টি ভিডিও বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন, একটিরও শিরোনামের (থাম্বনেইল) সঙ্গে ভেতরের আধেয়র (কনটেন্ট) মিল নেই।
নীতিমালা কী বলছে
ডিসমিসল্যাবের পক্ষ থেকে বিবিসির কাছে বিষয়টি নিয়ে ই-মেইল করা হয়েছিল। জবাবে বিবিসির প্রেস অফিস থেকে বলা হয়, অতীতে তাদের আইন শাখা থেকে ভুয়া ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘অ্যাকাউন্টে’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হয়নি।
ইউটিউবের মালিকানা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশন। ইউটিউবের ওয়েবসাইটে দেওয়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, নকল করা ও প্রতিলিপি তৈরি করা নিষিদ্ধ। নকল করা হলে চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হবে। অবশ্য ডিসমিসল্যাব বলছে, ৫৮টি চ্যানেলে তারা ইউটিউবের নীতিমালার পুরোপুরি লঙ্ঘন দেখতে পেয়েছে। কিন্তু চ্যানেলগুলো চলছে এবং সেখানে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়েছে। মানে হলো, ইউটিউবও এর মাধ্যমে আয় করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউটিউব এসব চ্যানেলকে ‘ভেরিফায়েড’ (স্বীকৃত) ব্যাজ দিয়েছে। যেমন বিবিআই (আই বর্ণটি সি বলে মনে হয়) আন্তর্জাতিক সংবাদ চ্যানেলটি ইউটিউব ‘ভেরিফায়েড’। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যানেলগুলো এমনভাবে টিক চিহ্ন ব্যবহার করেছে, যেখানে মনে হয় তারা ‘ভেরিফায়েড’।
‘নকল চ্যানেলগুলো বন্ধ করা উচিত’
দেশের ট্রেডমার্ক আইন-২০০৯ অনুযায়ী, কোনো ট্রেডমার্ক নকল করার সর্বোচ্চ শাস্তি অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড। সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল জগতে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, নকল ইউটিউব চ্যানেলগুলো বন্ধ করা উচিত। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এগুলো ব্লক করতে পারে এবং ইউটিউবকে তা অপসারণের জন্য অনুরোধ করতে পারে। তিনি বলেন, মিথ্যা বা অপতথ্য ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এর কারণ বাংলাদেশে ডিজিটাল জগৎ নিয়ে প্রযোজ্য আইনগুলোয় অপরাধগুলো সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত নেই। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য থাকায় আইনগুলো অপব্যবহারের সুযোগ রয়ে গেছে।