আলু | ফাইল ছবি |
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ: রাজশাহীতে এবার মাঠেই প্রায় তিন গুণ দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। গত বছর কৃষকেরা মাঠপর্যায়ে যেখানে প্রতি কেজি আলু ১১-১২ টাকায় বিক্রি করেছিলেন, সেখানে এবার বিক্রি হচ্ছে ৩৩ টাকায়। কৃষকেরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকেই চড়া দামে আলু কিনে নিচ্ছেন। সে জন্য তাঁরা সব আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে ব্যাপক হারে আলু কিনে নিয়েছেন, যাতে পরে বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে একচেটিয়া মুনাফা করতে পারেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা স্মরণকালে মাঠে আলুর এত দাম পাননি। এবার উৎপাদন কম হয়েছে। তাই দাম বেড়েছে। কিন্তু রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উৎপাদন ঘাটতির কথা মানতে নারাজ।
রাজশাহীতে গত বছর মৌসুমের শুরুতে মাঠে প্রতি কেজি আলু সাড়ে ১১ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার শুরুতে ২৫ টাকা ছিল, যা ইতিমধ্যে ৩৩ টাকায় উঠেছে। রাজশাহীর খুচরা বাজারে এখন ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছেন। তাঁরা আলু কিনে গুদামজাত করে রাখছেন। এতে কৃষকেরা আপাতত লাভবান হলেও পরে ব্যবসায়ীরা বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে একচেটিয়া মুনাফা করতে পারেন।
চাষিরা বলছেন, এ বছর এক বিঘা জমিতে আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা বেশি। জমির ইজারামূল্য, আলুবীজের দাম ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়েছে। গত বছর এক বিঘা জমির ইজারা মূল্য ছিল ১৫ হাজার টাকা, যা এবার বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। গতবার বীজ কেনায় বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা, এবার হয়েছে ১৮-২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শ্রমিকের জনপ্রতি মজুরি ৩০০ থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী জেলার ৯ উপজেলায় এবার ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। গত বছর হয়েছিল ৩৬ হাজার ৫০০ হেক্টরে। জেলার প্রায় অর্ধেকই চাষ হয় তানোর উপজেলায়। এদিকে শর্ষের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা এবার এটির চাষ বাড়িয়েছেন। এতে আলুর আবাদ কমেছে। গত বছর রাজশাহীতে ১০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছিল। এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ লাখ টন। তবে রাজশাহীতে বছরে আলুর চাহিদা ৮০ হাজার টন। উদ্বৃত্ত থাকা আলু অন্য জেলাগুলোয় যায়।
তানোর উপজেলার চাষি আবদুল আওয়াল জানান, এ বছর তিনি ৮০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। গত অক্টোবরের শেষে বৃষ্টির কারণে আলুর ফলন কম হয়েছে। আগে যেখানে এক বিঘা জমিতে ৭০ বস্তা পর্যন্ত আলু পাওয়া যেত, সেখানে এবার পাওয়া গেছে ৫৫-৫৭ বস্তা।
বিএডিসির সাবেক মহাব্যবস্থাপক আরিফ হোসেনও বলেন, এবার বৃষ্টিতে আলুর উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। আবার তীব্র শীতের সময়ে চাষিরা ছত্রাকনাশক ব্যবহার করায় তাতে আলুগাছ রক্ষা পেলেও ফলন কমে গেছে। আর ফলন কমার কারণেই আলুর দাম বেড়েছে। রাজশাহীর কৃষকেরা স্মরণকালে মাঠে এত বেশি দাম পাননি।
এদিকে ফলন কম হওয়ার কারণে রাজশাহীর সব হিমাগার এবার আলুতে ভরে যায়নি। রাজশাহী হিমাগার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান জানান, তাঁর নিজের পাঁচটি হিমাগারের মধ্যে দুটি ভরেছে। বাকি তিনটির একটির ১০ ভাগ, একটির ২০ ভাগ ও একটির ৩০ ভাগ খালি রয়েছে। তিনি বলেন, রাজশাহী জেলায় মোট ৩৬টি হিমাগার রয়েছে। এবারের আলু তোলা শেষ হয়ে গেলেও এখনো হিমাগারের ২০ শতাংশ খালি পড়ে রয়েছে।
তবে আলু উৎপাদনে ঘাটতির কারণে দাম বেড়েছে এমনটা মানতে নারাজ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপপরিচালক মোজদার হোসেন। তিনি বলেন, রাজশাহীতে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি উৎপাদন হয়েছে। কী কারণে দাম বেড়েছে, তা বলা যাচ্ছে না।
উৎপাদন মৌসুমে আলুর এত দাম বাড়ার বিষয়ে নতুন কথা বলছেন জেলা বিপণন কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন। সম্প্রতি রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বদলি হয়ে যাওয়া এই কর্মকর্তা বলেন, দাম বৃদ্ধি সম্পূর্ণ ব্যবসায়ীদের কারসাজি। যেখানে আলুর উৎপাদন খরচ ১৩ থেকে ১৪ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে তাঁরা ২৮-৩০ টাকা কেজি দরে কিনেছেন। ভালো দাম পেয়ে চাষিরাও মাঠেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন ব্যবসায়ীরা সব আলু মজুত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবেন।
মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, সাধারণত হিমাগারে রাখার পর চাষিদের ঘরে যে আলু উদ্বৃত্ত থাকে, তা দিয়ে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। জুলাই থেকে হিমাগারের আলু বাজারে আসে। নভেম্বর নাগাদ হিমাগারের আলু খালাস হয়ে যায়। গত বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি হঠাৎ অতিরিক্ত দামে ব্যবসায়ীরা চাষিদের উদ্বৃত্ত আলু কিনে নিয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। কিন্তু নভেম্বরে তাঁরা আর হিমাগারের আলু ছাড়েননি। দাম বাড়িয়ে ডিসেম্বরে ছাড়েন। এবারও তা-ই হবে। কারণ, মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের চাহিদা মেটানোর আলু চাষিদের ঘরে না উঠে ব্যবসায়ীদের গুদামে চলে গেছে। তাঁরাই এখন আস্তে আস্তে বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবেন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।