রাহীদ এজাজ: ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতি—এ তিনটি বিষয়কে নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল ১৫ জানুয়ারি। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি, প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এরই আলোকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কূটনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের ৯টি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা  জানিয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ওই নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি লেখা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই চিঠি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ৯ নির্দেশনার শুরুতেই নির্বাচন–পরবর্তী কূটনীতির প্রসঙ্গটি এসেছে। এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’—এই মূলনীতির আলোকে সরকার বৈদেশিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছে। ভূরাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা ও উপলব্ধি থাকতে পারে উল্লেখ করে চিঠিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছেন, সেসব উপলব্ধি ও যৌক্তিক পরামর্শগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের সব দেশের সঙ্গে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করবে।

এরপরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর, অর্থনৈতিক উত্তরণের পরিক্রমায় পণ্য ও জনশক্তির বাজার সম্প্রসারণ ও বিকল্প আমদানি উৎসের সন্ধান। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ, বাণিজ্যবিষয়ক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন, জনকূটনীতি, অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যু এবং জনবল ও বাজেটের যৌক্তিক সুষমকরণ।
রাষ্ট্রদূতদের কাছে নানা বিষয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নির্দেশনা দিয়ে পাঠানো চিঠির শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সদা পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুমাত্রিকভাবে বিস্তৃত করার প্রশংসা করেছেন।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত মার্চ ২৮  বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের মিশনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে কূটনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্প্রতি বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি।’

কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের তিনটি চ্যালেঞ্জের শেষ দুটি অর্থাৎ অর্থনীতি এবং কূটনীতি একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বিশেষ করে সমসাময়িককালের কূটনীতি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে অনেক বেশি ভূরাজনীতি এবং ভূ–অর্থনীতিকে ঘিরে আবর্তিত। আর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের অনেকগুলো দেশ। ফলে সরকারের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। ফলে পশ্চিমের প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে সুশাসন নিয়ে মতপার্থক্য ঘুচিয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থ কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যাবে, সেটি অনিবার্যভাবে সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশ ও জোটের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে যে বিষয়গুলোতে সরকারের সঙ্গে বন্ধু দেশ ও জোটের মতপার্থক্য রয়েছে বা তাদের উদ্বেগ রয়েছে, সেগুলোতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথাটি রাষ্ট্রদূতদের কাছে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দায়িত্ব নিলেও হাছান মাহমুদ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শুরুতে কাজ করেছিলেন। এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দিন তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেছিলেন।

গত ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে সেদিন সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের আগামী পাঁচ বছরে একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র উপস্থাপন করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার সামনে রেখে ২০২৪ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছবিটা কেমন, চ্যালেঞ্জগুলো কী তা তুলে ধরা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে কূটনীতির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গ টেনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সামগ্রিকভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত থাকা, ভূরাজনৈতিক ও ভূ–অর্থনৈতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বার্থে কোন দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে না পড়ে সবার সঙ্গে যুক্ততা এবং নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মধ্য দিয়ে কৌশলগত অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান, বিশেষ করে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য জোরালো প্রয়াস এবং এতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় সরকারের আগামী দিনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সরকারের সামনের দিনগুলোতে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে এ বছর থেকে বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারকে রাশিয়া, চীনের মতো বড় অংশীদারদের ঋণ ফেরত দেওয়া শুরু করতে হচ্ছে। ঋণ শোধের বিষয়টি কাকতালীয় এমন একসময়ে হচ্ছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতির ধাক্কা বাংলাদেশকে ভোগাচ্ছে। ফলে ডলার–সংকট মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগী এবং বন্ধু দেশগুলোর সহায়তা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। আবার বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে সুশাসন, শ্রম অধিকারের উদ্বেগ দূর করার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়াও জরুরি।

মানবাধিকার, বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ নাগরিক অধিকারের চর্চা, শ্রম অধিকার—এ বিষয়গুলো সরকারের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এক কূটনীতিক বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পাশাপাশি ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতায় মানবাধিকার অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে মানবাধিকার ও সুশাসনের নানা বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর যেসব উদ্বেগ রয়েছে, তা দূর করার লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত হওয়াটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

ভূরাজনীতি ও ভূ–অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, বিএনপির বর্জনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা ও বাণিজ্যের নিষেধাজ্ঞা দেবে এমন জল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটেনি। আবার নির্বাচনের পর একতরফা নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ তিন পক্ষের অবস্থানও বদল হয়নি। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ তাদের হতাশা স্পষ্ট করেই জানিয়েছে। ফলে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে দুই পক্ষকে দূরত্ব দূর করতে যে সামনে কাজ করতে হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। আর এ বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ৯টি নির্দেশনা রাষ্ট্রদূতদের দিয়েছেন, তার শুরুতেই এর উল্লেখ রয়েছে।