মহানগরে কিশোর বাইকার ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: পবিত্র রমজানের শেষে ঈদুল ফিতর উৎসবের বাকি আর কয়েক দিন। রাজশাহী মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। তবে এই উৎসব আয়োজনের মধ্যে দুশ্চিন্তাও ভর করেছে এখানকার মানুষের মনে। কারণ কিশোর বাইকার ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো।
এবার ঈদ উৎসবের আগেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর বাইকার ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সন্ধ্যার পরপরই শুরু হয় তাদের দৌরাত্ম্য। রাস্তায় বাইকার পার্টির বেপরোয়া প্রতিযোগিতার ভয় ও শঙ্কা নিয়ে চলাচল করছে পথচারী ও সাধারণ মানুষ। এতে ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও। এ ছাড়া তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যে কাউকে মারধর তো আছেই।
অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে কিছু উচ্ছৃঙ্খল কিশোর গ্যাং কালচারের চর্চা করছে। যাদের পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধন আছে। এ কারণে এরা কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। তবে থানা সূত্র বলছে, অধিকাংশ ঘটনায় মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিড়ম্বনার ভয়ে বেশির ভাগ অভিযোগ হয় না। ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
পথচারী ও স্থানীয়দের ভাষ্য, ঈদের আগ থেকেই রাজশাহী মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় কিশোর বাইকারদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাদের সংঘবদ্ধ বাইক রেস। সন্ধ্যার পর মহনগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থেকে রেলগেট হয়ে ভদ্রা, তালাইমারি, কাশিয়াডাঙ্গা থেকে আমচত্বর, আলুপট্টি থেকে তালাইমারি, বিমান চত্বর থেকে মেহেরচন্ডি, রেলগেট থেকে নওহাটা, পদ্মাপাড় ঘেঁষে চলা রাস্তাসহ আধুনিক আলোকসজ্জিত সড়কগুলোয় তাদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি।
কিশোরদের পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধন
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ রাখতে সরকারের আইন আছে। কিন্তু শুধু আইন দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কেউ কেউ আইন ভাঙতে পারলে খুশি হয়। বাইক চালানোর নিয়ম-কানুন না জেনেই কিশোররা বাইক চালায়। দু-একজন জানলেও অধিকাংশ কিশোর আইন মানতে চায় না। বর্তমানে কিছু উচ্ছৃঙ্খল কিশোর গ্যাং কালচারের চর্চা করছে। যাদের পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধন আছে। এ কারণে এরা কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। আর ঈদ উৎসব সামনে রেখে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ইফতার শেষে রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকা দিয়ে সন্ধ্যার পর হেঁটে যাচ্ছিলেন কলেজ-শিক্ষার্থী মো. ইত্তেদা। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর এ রাস্তা দিয়ে খুব সতর্কভাবে চলাচল করতে হয়। কখন যে কোন কিশোর বাইকার নিয়ে এসে ধাক্কা দেয়, সে ভয়ে থাকতে হয়। অভিজাত এলাকা হওয়ায় পুলিশের তদরকি এখানে খুব একটা দেখা যায় না।
আরেক কলেজ-শিক্ষার্থী দুর্জয় ইসলাম বলেন, শুক্রবার ইফতারের আগে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের পেছনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ চার রাস্তায় যানজট তৈরি হয়। দেখি বেশ কয়েকজন কিশোর মিলে এক গাড়িচালককে পেটাচ্ছে। যানজট দীর্ঘ হওয়ায় এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য গিয়ে থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তা-ও পিটিয়েই যাচ্ছিল। পরে পুলিশ দেখে কিশোররা পালিয়ে যায়। নগর সড়কে দাঁড়ালে এমন চিত্র প্রায়ই দেখা যাচ্ছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট তৌফিক হাসান টিটো বলেন, রাজশাহীতে ঈদকে কেন্দ্র করে শান্তির নগরীতে কিশোর বাইকারদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিশোর গ্যাং কালচার। এতে পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। আবার উঠতি বয়সী বাইকাররা আনন্দ উদযাপনের জন্য বাইক চালায় ওভার স্পিডে। ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিও ঘটে। ঈদের উৎসব যেন অসচেতনতার অভাবে মলিন না হয়ে যায়, সেদিকে অভিভাবকদের যেমন লক্ষ রাখতে হবে, তেমনি প্রশাসনকেও সজাগ থাকতে হবে।
কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে শাহমখদুম থানা পুলিশ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
যা বলছেন চিকিৎসকরা
প্রতি বছর ঈদ উৎসবের ছুটিতেই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের অর্থোপেডিকস ইউনিটে চাপ বেড়ে যায়। উৎসবকেন্দ্রিক বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এবারও নেওয়া হয়েছে প্রস্তুতি।
রামেক হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ঈদের ছুটিতে ১ মে থেকে ৪ মে পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২১৯ জন। ২০২৩ সালেও চিত্রও এক রকম বলে জানা গেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, একটু সতর্ক ও সচেতন হলেই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। সুতরাং একটি সুন্দর ঈদ উদযাপনের জন্য সবাইকে বেপরোয়া যেকোনও কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহম্মদ বলেন, জরুরি বিভাগে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। ছুটিতেও ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক থাকবেন। অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য জরুরি সেবাও চালু থাকবে।
অধিকাংশ ঘটনায় শুধু মুচলেকা
এদিকে থানায় লিখিত অভিযোগে পেলে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করছে। তবে অধিকাংশ ঘটনায় মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে থানা সূত্র বলছে, বিড়ম্বনার ভয়ে অধিকাংশ ঘটনা থানা পর্যন্ত যাচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
গত এক মাসের পুলিশের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টায় বোয়ালিয়া থানার গৌরহাঙ্গা এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আরএমপির শাহমখদুম থানা পুলিশ।
গ্রেপ্তার কিশোররা হলো রহিদুল ইসলাম (২০), রবিন (১৯), নাসির (১৯), রকি আহমেদ শিমুল (১৯) ও ফারহান আরাফাত (১৯)। তারা সবাই নগরীর বাসিন্দা।
এ বিষয়ে শাহমখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, গত ২৭ অক্টোবর পবা নতুনপাড়া আরডিএ মাঠের সামনে আরাফাত ও তার বন্ধু সাব্বিরকে অপহরণ করে মারপিট করার ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১ মার্চ আসামি রকি আহমেদ শিমুল ও ফারহান আরাফাত শাহমখদুম থানার মোড় এলাকার নূর জামানের মুরগির দোকানে মুরগি কিনে টাকা না দিয়ে বিক্রেতাকে মারধর ও হুমকি দেওয়ার মামলারও আসামি। ওই ঘটনায় পৃথক অভিযানে আরও ছয় কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. জামিরুল ইসলাম বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে পুলিশ আগে থেকেই কাজ করছে। ঈদ উৎসব সামনে রেখে প্রতি বছরই কিশোর বাইকাররা যেন রেসিং করতে না পারে, সে জন্য বিশেষ প্রস্তুতি থাকে। এবারও সেটা থাকবে।
যা বলছে পরিসংখ্যান
২০২২ সালে ঈদ উদযাপনের নামে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল কিশোর বাইকার ও কিশোর গ্যাং সদস্যরা। বাইক রেস করতে গিয়েই ঈদের আগে-পরে মাত্র এক সপ্তাহে বাইক দুর্ঘটনায় ছয় কিশোর বাইকারের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় আহত হয় আরও আড়াই শতাধিক। তাদের অধিকাংশকেই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।
২০২২ সালের ২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর আলিফ লাম মিম ভাটার মোড় থেকে বিহাস পর্যন্ত সড়কে দুই কিশোর বাইকারের রেস চলছিল। এ সময় তনু (৫৫) নামে এক পথচারীকে বেপরোয়া গতির একটি বাইক ধাক্কা দেয়। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ওই দুই কিশোর বাইকারকে আটক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঈদের পরের দিন ৪ মে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার লস্করহাটি এলাকায় দুই বাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সময় উপজেলার পাহাড়পুর নামাজ গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে কিশোর বাইকার নাঈম হোসেন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও তিন কিশোর। ঈদের আগের দিন ২ মে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রজব আলী সন্ধ্যার পর বেপরোয়া মোটরবাইকসহ একটি গাছে ধাক্কা খায়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।