রাজশাহী কোর্ট কলেজের সামনের পুকুর এখন খেলার মাঠ। গত বছরও সেপ্টেম্বরেও পুকুর ছিল। নগরের হড়গ্রাম এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: চারদিকে ইটের সীমানাপ্রাচীর। ভেতরে ইট-সুরকি-বালুর ভরাট। তার মধ্যে একটি শিশু মাছ ধরছে। বালু দিয়ে ভরাট স্থানটির ওপর দিয়ে অনেকে অনায়াসে হেঁটেও যাচ্ছেন। অথচ মাস দুয়েক আগেও এই সীমানাপ্রাচীরের ভেতরের জায়গাটি ছিল গভীর, পানিতে ছিল ভরপুর। রাজশাহী নগরের শতবর্ষী একটি পুকুরের চিত্র এটি। সম্প্রতি নগরের শিরোইল কলোনির শিরোইল পুকুরটি রাতের অন্ধকারে ভরাট করা গেছে। পুকুরটি আয়তনে ছিল দুই বিঘা।
শুধু এই পুকুর নয়, গত এক বছরে রাজশাহী নগরের এ রকম অন্তত পাঁচটি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। সেগুলোর কোনোটি আংশিক, কোনোটি পুরোপুরি ভরাট করা হয়েছে। অথচ রাজশাহীর পুকুর-জলাশয় নিয়ে একটি রিটের আদেশে উচ্চ আদালত পুকুর রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশ আইনও তাই বলছে। কিন্তু আইনে থাকলেও পুকুর ভরাটে কোনো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না। জলাশয় কমে যাওয়ায় ক্রমেই রাজশাহীতে তাপমাত্রা বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটলে জলাশয়–সংকটে বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, পুকুর ভরাট থামানো যাচ্ছে না। অনেকের ব্যক্তিগত পুকুর, সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই তাঁরা পুকুর রক্ষা করতে একটি প্রকল্প পাসের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন ২০১৯ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা পাস হয়নি। কারণ, ব্যক্তিগত পুকুর রক্ষা করার একমাত্র উপায় পুকুর কিনে নেওয়া।
নগরের শিরোইল এলাকায় গিয়ে ৫২ বছর বয়সী এ কে আজাদ ও ৩০ বছর বয়সী মো. সুমনের সঙ্গে শিরোইল পুকুর নিয়ে কথা হয়। সুমন বলে ওঠেন, ‘এই পুকুর নিয়ে কত স্মৃতি! এই পুকুরে সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শুধু সাঁতারই কাটতাম। আমরা রক্ষা করতে পারলাম না। এখন এই এলাকায় আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস পানি পাবে কোথায়?’ এ কে আজাদ বলেন, ‘একসময় এই পুকুরের পানি দিয়ে রান্নাবান্না হতো। অনেকে খাওয়ার জন্যও নিত।’
রাজশাহী নগরের মেহেরচন্ডী দায়রাপাক এলাকার কলমি পুকুর। পুকুরটি সম্প্রতি ভরাট শুরু হয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নগরের কোর্ট কলেজের পাশে আরেকটি বিশাল আকৃতির পুকুর ছিল। গত রোববার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, সেই পুকুরে বালু ফেলে ভরাট করার কাজ শেষ। ভরাট করা পুকুরের ওপর কয়েকজন তরুণ, শিশু ফুটবল খেলছে। রকি নামে এক তরুণ বললেন, মাস ছয়েক আগে পুকুরটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
আবার নগরের মোহনপুর এলাকায় ফল গবেষণাগারের ঠিক পেছনে আংশিক পড়ে আছে জেবর মিয়ার পুকুর। এটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত পুকুরের তালিকার একটি। এর বেশির ভাগ অংশ গত এক বছরে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে প্লট আকারে জমি বিক্রি করা হচ্ছে। সাইদুর রহমান নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, জেবর মিয়া জমি কিনে পুকুর করেছিলেন। তিনি তো নেই, তাঁর ছেলেমেয়েরাও বোধ হয় নেই। এখন নাতি-নাতনিরা আছেন। তাঁরাই বিক্রি করছেন।
রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী এলাকার শতবর্ষী কলমি পুকুরে সম্প্রতি কয়েক ট্রাক বালু ফেলা হয়েছে। পুকুরটি নাটোরের মালিকের কাছ থেকে শমসের আলী নামের একজন মাছ চাষের জন্য তিন বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন। শমসের আলীর স্ত্রী শেফালি বেগম বলেন, পুরো তিন বছরই বাকি আছে। হঠাৎ শোনা গেল, মালিক পুকুর বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে রাতেই পুকুর ভরাট করতে স্থানীয় লোকজন বাধা দেন। এই পুকুর তাঁরা ভরাট করতে দেবেন না।
রাজশাহী নগরের মেহেরচন্ডী দায়রাপাক এলাকার কলমি পুকুর। পুকুরটি সম্প্রতি ভরাট শুরু হয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহীতে পুকুর ভরাট ও দখল নিয়ে ২০১০ সালে প্রথম রিট করেন নদী–গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহাবুব সিদ্দিকী। পরে ২০১৪ সালে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’–এর পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সর্বশেষ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে নগরে পুকুর গণনা করে বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়। খতিয়ান, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণসহ মোট ৯৫২টি পুকুরের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর ৪৮টি। বাকিগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন। সরকারি পুকুরের মধ্যে বৈধভাবে ৯টি ও অবৈধভাবে ৮টি ভরাট করা হয়েছে। বাকিগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৮ আগস্ট রাজশাহী শহরের পুকুরগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সিটি মেয়র, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও র্যাবকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পুকুর ভরাটের তালিকা করে থাকে। তাদের মতে, গত এক দশকে এই শহরের ৯৭ ভাগ পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। বেলার রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল বলেন, পুকুর বা জলাশয় ভরাটে বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রচলিত আইন আছে, যেগুলো দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া জমির শ্রেণিও পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও জলাশয় ভরাট চলছেই। তাহলে আইন থেকে কী লাভ? রাজশাহীর আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। পুকুর জলাশয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আর রাজশাহী শহরের সাহেববাজার এলাকায় যদি বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে, তখন পানি পাওয়া যাবে কোথায়?
জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেখানেই খবর পাচ্ছি, সেখানেই যাচ্ছি। অনেকেই রাতে রাতে ভরাট করার চেষ্টা করছে। রাত তিনটার সময় ওখানে ম্যাজিস্ট্রেট রাখা কঠিন। অন্য সময় যখনই খবর পাচ্ছি, তখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।’