বেআইনি হলেও প্রকাশ্যে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে পুকুরটি। রোববার রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি রাজশাহী: পরিবেশ আইন অমান্য করে রাজশাহী মহানগরে রাতের আঁধারে পুকুর ভরাট চলছেই। মহানগরের চন্দ্রিমা থানার মেহেরচণ্ডী মৌজায় দেড় একর আয়তনের ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। কাগজে-কলমে পুকুরটির শ্রেণি ‘ভিটা’ দেখিয়ে মালিকপক্ষ ভরাট করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ২৫ মার্চ রাত থেকে প্রতি রাতে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। অথচ পুকুরটি এখনো তিন বছরের জন্য এক ব্যক্তির কাছে ইজারা দেওয়া আছে।

মহানগর এলাকার মধ্যে বড় একটি জলাধারের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হচ্ছে অথচ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘ডিসি, এসপি’র নাম ভাঙিয়ে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। কিন্তু ডিসি, এসপি কোন এলাকার, তা কেউ বলতে পারছেন না। মেহেরচণ্ডী মৌজায় পুকুরটির আরএস খতিয়ান নম্বর ৪৮৮ এবং দাগ নম্বর ২৪৭৮।

অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, তারা নির্দিষ্ট করে বলুক কোন এসপি এবং কোন ডিসি এর সঙ্গে জড়িত, তাহলে তিনি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারেন। আগামীকালই (সোমবার) ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত), ২০১০ অনুযায়ী, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে জলাধার–সম্পর্কিত বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে। অন্যদিকে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এর বিধান অনুসারে ব্যক্তিগত পুকুরও জলাধারের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা ভরাট করা যাবে না।

জানতে চাইলে রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাহমুদা পারভীন বলেন, পুকুরের শ্রেণিভুক্ত কোনো জায়গা পরিবেশ আইন অনুযায়ী ভরাট করা যাবে না। অভিযোগ পেলে এই পুকুরের শ্রেণি যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১২ মার্চ রাজশাহীর রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর শাম্মী আক্তার পুকুরটির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য নাটোর সদর থানা এলাকার বাসিন্দা গোলাম মওলার আবেদনের বরাত দিয়ে নগরের বোয়ালিয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর একটি চিঠি পাঠান। যাঁরা পুকুরটি ভরাট করছেন, তাঁরা এখন বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুরটির শ্রেণিকে ভিটায় রূপান্তর করা হয়েছে।

রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী এলাকার পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার বোয়ালিয়ার সহকারী কমিশনার জুয়েল আহাম্মেদকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, তিনি এক দিন আগে বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে তিনি বলতে পারবেন। কিছুক্ষণ পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো আবেদন বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়ে আসেনি।

বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সরকার অসীম কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি সদ্য দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনিও পরে খোঁজ নিয়ে জানাতে চান। কিছুক্ষণ পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই দাগ নম্বরের কোনো পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়নি। তারপর তাঁকে রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরের চিঠিটি পাঠানো হলে তিনি বলেন, সোমবার অফিস খুললে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করে বলতে পারবেন।

এদিকে পুকুরটি ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করতেন কয়েকজন। তাঁদের একজন মো. টুটুল। তাঁর ভাই সোহেল রানা বলেন, তাঁরা এই পুকুরে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে আগামী তিন বছর পর্যন্ত পুকুরটি তাঁদের জিম্মায় রয়েছে। অথচ প্রতি রাতে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। শুক্রবার রাতে তিনি বলেছিলেন, তিনি নগরের চন্দ্রিমা থানায় মামলা করতে যাচ্ছেন। পরে তিনি আর কোনো যোগাযোগ করেননি। তিনি শুরুতেই বলেছিলেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুরটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা কিনেছেন, তাঁদের একজন আবদুল হালিম।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আবদুল হালিম বলেন, পুকুরটি তিনি কেনেননি। তবে কেনার পরিকল্পনা করছেন। ভরাট করছেন কারা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাঁরা পুকুরের মালিক, তাঁরাই ভরাট করছেন।

যোগাযোগ করা হলে মো. টুটুল বলেন, পুকুর ভরাট শুরুর কয়েক দিন পর মালিকপক্ষের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে নির্ধারণ করা টাকার সিংহভাগই বুঝে পেয়েছেন। অল্প কিছু বাকি। এই পুকুরের মালিকানায় কারা আছেন, সেসব নিয়ে তিনি এখন কথা বলতে চান না।

শনিবার রাত ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের নবনির্মিত আলিফ লাম মিম ভাটার মোড়-বিহাস সড়কে গিয়ে দেখা যায়, বালুঘাট থেকে সারি সারি ট্রাক বালু নিয়ে মেহেরচণ্ডীর ওই পুকুরে যাচ্ছে। একসঙ্গে সাত-আটটি ট্রাক বালু নিয়ে চলে আসার কারণে একটু দূরে সার বেঁধে অপেক্ষা করছে। একটি ট্রাক বালু ফেলে আসার পর অন্যটি যাচ্ছে। ২৫ মার্চ থেকে প্রতি রাতেই এভাবে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। দিনে কাজ পুরোপুরি বন্ধ থাকছে।

পুকুরে বালুভরাটের কাজ দেখাশোনা করছেন নগরের বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. মাসুম। তিনি বলেন, ‘এই পুকুরে এসপি-ডিসির মালিকানা আছে। তাঁরাই ভরাট করছেন। ভরাটের আগে এটার শ্রেণি ভিটা করে নেওয়া হয়েছে।’ আসলেই এটা ভিটা, নাকি পুকুর—এমন প্রশ্নে মাসুম বলেন, ‘পুকুরই তো দেখছি। এখন কাগজে-কলমে ভিটা করে দিলে আমাদের কী! সবই তো সম্ভব।’ কোন জেলার এসপি-ডিসি এই পুকুরের মালিকানায় আছেন, তা জানতে চাইলে মাসুম বলেন, ‘সেটা আমি বলতে পারব না। লালন ভাই বলতে পারবেন।’

লালন শেখের বাড়িও নগরের বুধপাড়া এলাকায়। তিনি মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সদস্য। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুয়ার্ড শাখার নিরাপত্তা প্রহরী। যোগাযোগ করা হলে লালন শেখ বলেন, ‘এই পুকুরের মালিক কে, সেটা আমিও জানি না। আমাকে ভরাট করার জন্য অন্য ব্যক্তি কাজ দিয়েছে। আমি ভরাট করছি।’ পুকুর ভরাট আইনে নিষিদ্ধ, এটা জানেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এত কথা আমি বলতে পারব না।’

রাজশাহীতে পুকুর ভরাট ও দখল নিয়ে ২০১০ সালে প্রথম রিট করেন নদী-গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহাবুব সিদ্দিকী। পরে ২০১৪ সালে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সর্বশেষ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে নগরে পুকুর গণনা করে বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়। খতিয়ান, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণসহ মোট ৯৫২টি পুকুরের তালিকা পাওয়া যায়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৮ আগস্ট রাজশাহী শহরের পুকুরগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সিটি মেয়র, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও র‌্যাবকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।