আফরোজা আক্তার আঁখি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সরোয়ার মোর্শেদ: পাবনার সুজানগর উপজেলার ভায়না গ্রামের বাসিন্দা আফরোজা আক্তার (আঁখি)। সুন্দর জীবন গড়ার জন্য একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েননি তিনি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর কারখানায় তৈরি হস্তশিল্পসামগ্রী যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কর্মসংস্থান হয়েছে দুই শতাধিক মানুষের।

পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে স্নাতক (সম্মান) শেষ না করেই আফরোজাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। তবে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে মাত্র চার মাসের মাথায় ভেঙে যায় তাঁর সংসার। এর এক বছরের মাথায় ২০১৫ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন। পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তবে মনমতো চাকরি পাচ্ছিলেন না। ভর্তি হন পাবনার একটি আইন কলেজে। আইনে ডিগ্রি নিয়ে এই পেশায় প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলেন। সফল হতে পারেননি। ভাগ্যবদলের আশায় ধারদেনা করে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি স্বামী কাতারে যান। ২০২০ সালে করোনার সময় চাকরি হারিয়ে স্বামী ফেরেন খালি হাতে। দুই সন্তানসহ আফরোজার চারজনের সংসার আর চলছিল না।

আফরোজা সরকারের উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের (ইএসডিপি) একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেখানে হস্তশিল্পসামগ্রী তৈরির কাজ শিখেছিলেন। একসময় হস্তশিল্পসামগ্রী তৈরির ব্যবসা করার কথা মাথায় আসে তাঁর। সেই চিন্তা থেকে মাত্র এক কেজি পাট কিনে কয়েকটি ঘর সাজানোর পণ্য (শোপিস) ও পা বা জুতার ময়লা মোছার পণ্য (পাপোশ) তৈরি করেন। কয়েক দিন পর সেগুলো নিয়ে পাবনা শহরে পরিচিত এক সরকারি কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। ওই কর্মকর্তা তাঁর কাছ থেকে সেগুলো এক হাজার টাকায় কিনে নেন।

ওই সরকারি কর্মকর্তা হস্তশিল্পসামগ্রী প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিডি ক্রিয়েশনের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আফরোজা আক্তারের পরিচয় করিয়ে দেন। এর কিছুদিন পর এক হাজার টাকায় আটটি পাপোশ তৈরি করে তিনি বিডি ক্রিয়েশনে যান। পাপোশগুলো পছন্দ হয় তাদের। তাঁকে আরও ২৫টি পাপোশ তৈরির ফরমাশ দেন। অগ্রিম দুই হাজার টাকাও দেন। এরপর ৫০, ১০০, ৫০০ থেকে এখন প্রতি সপ্তাহে পাপোশসহ নানা ধরনের ১ হাজারটি হস্তশিল্পসামগ্রী ওই প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন তিনি।

আফরোজার হস্তশিল্প পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় গড়ে তোলেন নিজের কারখানা। নাম মেসার্স ফেমাস হ্যান্ডিক্র্যাফটস। বিডি ক্রিয়েশনের মাধ্যমে এই কারখানার পণ্য যাচ্ছে ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। প্রতি মাসে তাঁর আয় হচ্ছে দুই লাখ টাকা।

কারখানায় একদিন
সবুজ ছায়াময় নিভৃত গ্রাম ভায়নায় স্বামীর বাড়ির এক পাশে আফরোজার কারখানা। সম্প্রতি কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, প্রবেশমুখে কয়েকজন নারী মাদুর পেতে বসে পণ্যের শেষ পর্যায়ের কাজ করছেন। ভেতরে ইলেকট্রিক সেলাই মেশিনে চলছে বাহারি পণ্য তৈরির কাজ। কর্মীদের অধিকাংশই নারী।

সেখানেই কথা হয় আফরোজা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুরুতে বিডি ক্রিয়েশন থেকে পাওয়া দুই হাজার টাকায় তিনি কাঁচি ও পাট কিনে মেশিন ছাড়াই হাতে কাজ করেছিলেন। পরে কাজ বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে নিজের জমানো ১ লাখ, স্বামীর জমি বন্ধক রেখে ২ লাখ এবং ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ১০টি সেলাই মেশিন কেনেন। বর্তমানে তাঁর কারখানায় ৪০টি মেশিন আছে। সেখানে কাজ করছেন ৫০ জন নারী। এ ছাড়া কারখানার বাইরে বাড়িতে বসে কাজ করেন প্রায় ১৫০ জন নারী। তিনি এখন পাটের তৈরি ব্যাগ, স্কুলব্যাগ, নারীদের ব্যবহৃত (ভ্যানিটি) ব্যাগ, ফুলের টব, শোপিস, পাপোশ, ফ্লোর ম্যাট, হোগলাপাতার ঝুড়িসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন।

সাফল্য কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে আফরোজা আক্তার বলেন, জীবনে চড়াই-উতরাইয়ের শেষ ছিল না। তবে কোনো দিন ভেঙে পড়েননি। পণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখেছেন। চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো পণ্য সরবরাহ করেছেন। আর এসব কারণেই হয়তো সাফল্য পেয়েছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে তাঁর দুই লাখ টাকা আয় থাকে বলে জানালেন। একসময় দুঃস্বপ্নে ডুবে থাকলেও এখন তিনি অনেক নারীর কাছে অনুপ্রেরণার নাম। পেয়েছেন সেরা জয়িতা, সেরা উদ্যোক্তাসহ কয়েকটি পুরস্কার। গ্রামের লোকেরা ভালোবেসে তাঁকে ‘আঁখি আপা’ নামে ডাকেন।

কর্মীদের ভরসা
কর্মীদের কাছে আফরোজা আক্তার আস্থা ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। অনিতা সরকার নামের এক কর্মী বলেন, চার বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে নিয়ে খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। আফরোজার কারখানায় কাজ পেয়ে তাঁর সংসারের অভাব দূর হয়েছে। এখন ছেলেকে নিয়ে ভালো আছেন।

আরমিন আক্তার নামের আরেক কর্মী বলেন, খুব অভাব-অনটনে ছিলেন তিনি। গ্রামে তেমন কাজের সুযোগ ছিল না। কিছু করতে পারছিলেন না। এখন বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারছেন। অভাবও দূর হয়েছে।

আফরোজা নিজের চেষ্টায় সাফল্য পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তাঁর স্বামী আবদুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, শত কষ্টেও আফরোজা কোনো দিন ভেঙে পড়েননি। চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাই তিনি ব্যবসায় সফল হয়েছেন।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পাবনা অঞ্চলের উপমহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আফরোজার মধ্যে চেষ্টা আছে। তিনি তাঁর চেষ্টা ও পরিশ্রমের কারণেই সফল হয়েছেন। চলতি বছরের জেলা পর্যায়ের বিসিক উদ্যোক্তা মেলায় তিনি সেরা হয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও ভালো করবেন বলে প্রত্যাশা করছি।’

পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আলী মুর্তজা বিশ্বাস বলেন, মানুষ চেষ্টা, শ্রম ও মেধা দিয়ে যে শূন্য থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, আফরোজা আক্তার এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হস্তশিল্পসামগ্রী তৈরি করে তিনি নিজে শুধু স্বাবলম্বী হননি; বরং গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করেছেন। তাঁর এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে আফরোজা আক্তার বলেন, ‘গ্রামে এখনো অনেক অসহায় নারী আছেন। তাঁদের স্বাবলম্বী করতে চাই। নিজের কাজের সঙ্গে আরও অনেক মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চাই। ভবিষ্যতে বিদেশে পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা আছে।’