প্রচণ্ড গরমে বাইরে কিছুক্ষণ থাকলেই পানির তেষ্টা পায়। তৃষ্ণা মেটাতে পানি পান করছেন এক রিকশাচালক। গৌড়হাঙ্গা গোরস্থান, রাজশাহী, ২৬ এপ্রিল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সাদ্দিফ অভি: তীব্র গরম বইছে সারা দেশে। অসহনীয় তাপপ্রবাহের কারণে মানুষের জীবন অতীষ্ঠ। শনিবার সকালে হাঁটার পথে দেখা গেলো— এক ব্যক্তি দোকান থেকে ছোট এক বোতল কোমল পানীয় কিনে পান করছেন। সকালে তেমন গরম না পড়লেও কোমল পানীয় কেন খাচ্ছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, খেতে ভালো লাগে আর পানির পিপাসা। দিনে এরকম কতবার খাওয়া হয় জানতে চাইলে তার উত্তর— বেশ কয়েকবার। পানি কেন খাচ্ছেন না প্রশ্নে তিনি জানান, স্বাদ না পাওয়ায় কারণে পানি বার বার খেতে ইচ্ছা করে না।

কিছু দিন ধরে দেশজুড়ে তাপমাত্রা  গড়ে ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি থাকছে প্রতিদিনই। দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ ছাড়িয়েছে ৪২ ডিগ্রি। আবহাওয়া অফিস আগামী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলেছে—   রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনা জেলাগুলোর ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং টাঙ্গাইল, বগুড়া, বাগেরহাট, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ রংপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগসহ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের বাকি অংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

এতে আরও বলা হয়, সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব বিরাজমান থাকতে পারে।

তীব্র তাপপ্রবাহে নাকাল জনজীবন। আর এই তাপপ্রবাহে বাড়ছে ‘হিটস্ট্রোকের’ ঝুঁকি। এর থেকে বাঁচতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন অনেকে। ঠান্ডা পানি, জুস, কোমল পানীয় খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করেন অনেকেই। আর এতে অজান্তেই তারা বিপদ ডেকে আনছেন বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। কারণ, গরমে ঠান্ডা পানীয় থেকে না ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

শনিবার দুপুরে কলাবাগান এলাকার একটি বিরিয়ানির দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেলো— অন্যরকম একটি দৃশ্য। ভরদুপুরে গরমের মধ্যে দোকানের কোনও চেয়ার ফাঁকা নেই। দুপুরের খাবার হিসেবে বিরিয়ানি খাচ্ছেন অন্তত ৩০ জন মানুষ। এর মধ্যে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীও আছেন।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুপুরে সাধারণত ভাত-তরকারি খেলেও মাঝেমধ্যে বিরিয়ানি খাওয়া হয়। আবার কেউ কেউ খরচ কমাতে কম দামের বিরিয়ানি খেয়ে থাকেন। তবে তাদের মতে, যে খরচ কম দামের বিরিয়ানির জন্য করা হয়— সেই দামে সাধারণ ভাত-তরকারি খাওয়া যায়। প্রতিদিনের স্বাদে কিছুটা ভিন্নতা আনার জন্য অনেকে বিরিয়ানি খেয়ে থাকেন বলেও জানান।  

২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে— দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর, যা ২০২২ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৪ বছর। ফলে এক বছরের ব্যবধানে দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে। বিবিএসের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে আরও জানা গেছে, মৃত্যুর জন্য দায়ী শীর্ষ ১০টি কারণের মধ্যে প্রথম কারণ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং দ্বিতীয় কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে বা স্ট্রোকে মৃত্যু । ২০২৩ সালে মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে ৬.১ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৫.৮ শতাংশ।

হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা মনে করেন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস এবং জীবনযাপন।

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘গরমের সময় বরফ ও ঠান্ডা যেকোনও কিছু খেতে আমরা মানা করি। গরমে ঠান্ডা পানীয়, তরল কিছু খেলে গলায় থাকা কিছু সুবিধাবাদী জীবাণু সক্রিয় হয়ে টনসিলাইটিস এবং ফ্যারেনজাইটিসের মতো রোগ সৃষ্টি করে। এটি শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করার ফলে নিউমোনিয়া হতে পারে। অপরদিকে গরমের সময় আমাদের শরীরের রক্তবাহী ধমনীগুলো সম্প্রসারিত হয়। হঠাৎ করে ঠান্ডা খেলে রক্তবাহী ধমনীগুলো সংকুচিত হয়। এই সংকোচনের কারণে শরীরে এক ধরনের ঝিমঝিমে ভাব হতে পারে। বেশি ঠান্ডা খেলে যাদের হৃদরোগ আছে, তাদের হার্টের ধমনী সংকুচিত হয়ে বুকে ব্যাথা অনুভব করতে পারে, কিংবা জ্ঞানও হারাতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তীব্র হার্টের সমস্যাজনিত রোগী হঠাৎ করে ঠান্ডা খেলে তার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।’

ডা. লেলিনের মতে, গরমের সময় সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়া উচিত। চর্বি জাতীয় তৈলাক্ত খাবার যেমন- বিরিয়ানি যারা খাচ্ছেন, তাদের হজম বিলম্বিত হয়।  শরীরে এই সময়টুকু অস্বস্তি তৈরি করে এবং পানির পিপাসা পায় বারবার। এমনিতেই শরীর থেকে ঘামের সঙ্গে পানি বেরিয়ে যায়। একদিকে গরমের কারণে পানি কমে পিপাসা পায়, আর অপরদিকে বিরিয়ানির মতো তৈলাক্ত খাবার পিপাসা বাড়ায়। এই দুইয়ের কারণে বারবার পানি খেয়েও স্বস্তি আসে না। এজন্য আমরা গরমে চর্বি জাতীয় কিংবা তৈলাক্ত খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

হার্ট অ্যাটাকে মানুষের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা ঐতিহ্যগতভাবে শর্করা জাতীয় খাবার বেশি খাই এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার কম খাই। যেকোনও মানুষের খাবারে এক ভাগ শর্করা থাকে, যা ৫০ শতাংশের বেশি না, ২৫-৩০ শতাংশ আমিষ থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ ৮০-৯০ শতাংশ শর্করা জাতীয় খাবার খেয়ে থাকেন। এর কারণে আমাদের রক্তে কোলেস্টেরল, ফ্যাটি লিভারের মতো রোগ দেখা দেয়। কোলেস্টেরল হৃদপিণ্ডের ভেতরের ধমনীর যে ছিদ্রপথ সেটি সরু করে ফেলে। যার কারণে হার্ট অ্যাটাক বেশি হয়। দ্বিতীয়ত , যারা অলস জীবনযাপন করে , শারীরিক পরিশ্রম করে না, সেটির কারণেও হার্ট অ্যাটাক বেশ হয়ে থাকে।’