কারাগার | প্রতীকী ছবি

প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ: দুটি মামলায় ৯ মাসের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন মো. হাফিজ উদ্দীন (৬৮) ও তাঁর ছেলে মারুফ ইসলাম (২৪)। এই সময়ের মধ্যে তাঁদের জামিনের আবেদন করা সম্ভব হয়নি। এই দুই মামলার বাদী আইনজীবী ও তাঁদের বাবা সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হওয়ায় আসামি বাবা-ছেলের জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য পক্ষে কোনো আইনজীবী পাওয়া যায়নি।

কারা কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে আইনজীবী নিয়োগের জন্য আসামিদের পক্ষে আবেদন জানায়। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি একজন আইনজীবীকে দায়িত্ব দেয়। কিন্তু সেই আইনজীবীও আসামিদের পক্ষে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন বাদী আইনজীবী হওয়ায়।

ঘটনাটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে দায়িত্ব পাওয়া আইনজীবী আবু হাসিব আসামিদের পক্ষে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশের বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন।

জানা গেছে, আসামি হাফিজ উদ্দীন ও তাঁর ছেলে মারুফ ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের বিরামপাড়ার বাসিন্দা। তাঁরা ৯ মাস ২২ দিন ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কারাগারে আছেন। তাঁরা ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আত্মসাতের দুটি মামলার আসামি। এ মামলার প্রধান আসামি মো. আকবর হচ্ছেন হাফিজ উদ্দীনের জামাতা। আকবর সচ্ছল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) তিন পরিচালকের একজন। এই সমিতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জজকোর্টের পিপি নাজমুল আজমের স্ত্রী বেগম রোকেয়া ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জমা রাখেন। ওই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মামলা করেন নাজমুল আজমের দুই ছেলে। তাঁরাও পেশায় আইনজীবী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য।

হাফিজ উদ্দীনের স্ত্রী রাবিয়া বেগম স্বামী ও ছেলের পক্ষে আইনজীবী পেতে এবং উচ্চতর আদালতে আবেদনের জন্য মামলার কপি পেতে গত ২১ মার্চ ডাকযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মোহা. আদীব আলী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সোলায়মান বিশুর কাছে লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন।

আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৫ জুলাই থেকে রাবিয়া বেগমের স্বামী ও ছেলে জেলা কারাগারে বন্দী। টাকা আত্মসাতের সঙ্গে বা সচ্ছল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির সঙ্গে তাঁর স্বামী কোনোভাবেই জড়িত নন। ছেলে সমিতির একজন মাঠকর্মী মাত্র। মামলায় তাঁদের দায়ী করে পুলিশ এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি। জেল সুপারের মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল কর্মকর্তার কাছে আইনজীবী নিয়োগের আবেদন জানানো হলে লিগ্যাল এইড অফিস থেকে আইনজীবী আবু হাসিবকে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। তবে আবু হাসিবও মামলা পরিচালনা করতে লিখিতভাবে বিব্রত বলে জানান।

রাবিয়া বেগম আবেদনে বলেন, মামলার বাদী আইনজীবী হওয়ায় কোনো আইনজীবী পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামী ও সন্তান দীর্ঘদিন কারাগারে। সংসারে উপার্জনক্ষম আর কোনো ব্যক্তি না থাকায় তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি আইনজীবীর সহযোগিতা পাওয়া ও ঊর্ধ্বতন আদালতে জামিনের আবেদন করার জন্য মামলার কপি পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন।

এ প্রসঙ্গে সোলায়মান বিশু বলেন, মামলা বাদী আইনজীবী হলে বা আইনজীবীর বিপক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়তে পারবেন না, এমন নিয়ম নেই। তবে কোনো মামলা গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারটি আইনজীবীদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে রাবিয়া বেগমের আবেদনের ব্যাপারটি জেলা আইনজীবী সমিতির আগামী সাধারণ সভায় উত্থাপন করা হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিপি নাজমুল আজম প্রথমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে বলেন, ‘আমার স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সমিতিটির পরিচালক আকবর ছিলেন তাঁর ছাত্র। আমার স্ত্রীকে “মা” ডাকতেন। তিনি (স্ত্রী) সমিতিতে টাকা জমা রাখলে অন্যরা আস্থা পাবেন বলে আকবর অনুনয়-বিনয় করে রাজি করান। তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় ও চাকরির পাওনা টাকা মিলিয়ে ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জমা রাখেন। কিন্তু সেই টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এ নিয়ে সালিস হয়। সালিসে আকবর ৬০ লাখ টাকা মূল্যের জমি দেবেন সিদ্ধান্ত হয়। বাকি টাকা জামিনে বের হওয়ার পর সব পরিচালক মিলে পর্যায়ক্রমে দেবেন কথা হয়। কিন্তু আকবরের দেওয়া জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার পর দেখা যায়, জমির মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। আমি জমি ফিরিয়ে দিয়ে ৬০ লাখ টাকা দিতে বলি অথবা জমির সঙ্গে আরও ২৫ লাখ টাকা দিতে বলি। বাকি টাকা দিলে মামলা প্রত্যাহার করা হবে।’

নাজমুল আজম বলেন, ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন। টাকার শোকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে গেছে আমার ছেলেরা। শুধু আমার স্ত্রীর নয়, অন্যান্য মানুষের ২০-২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আকবর ও তাঁর সহযোগীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’

আকবরের অপরাধে তাঁর শ্বশুর ও শ্যালককে কেন মামলায় জড়ানো হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে নাজমুল আজম বলেন, তাঁরাও এ সমিতির সঙ্গে জড়িত। আকবর তাঁর শ্বশুরকে ১৮ লাখ টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁদের আসামি করা হয়েছে।

নাজমুল আজমের অভিযোগের ব্যাপারে রাবিয়া বেগম বলেন, ‘আমার দুই ছেলে প্রবাসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। তাদের পাঠানো টাকা ও এনজিওর কাছে ঋণ নিয়ে বাড়ি বানানো হয়েছে। তাদেরও আসামি করা হয়েছে। আমার মেয়ে (আকবরের স্ত্রী) অন্য একটা এনজিওতে চাকরি করে। সমিতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। এখন মেয়েও গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’