ফেরদৌস ফয়সাল: আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ছিলেন কপটদের সরদার। আর তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ ছিলেন রাসুল (সা.)-এর একনিষ্ঠ সাহাবি। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর মৃত্যুর সময় তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ নবীজি (সা.)-এর কাছে দৌড়ে এলেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে আবেদন জানিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনার পবিত্র মুখে খানিকটা পানি নিয়ে সেটি গ্লাসে দেবেন? হয়তো আপনার মুখের ছোঁয়া পানির বরকতে আমার আব্বা মুসলমান হয়ে যাবেন!’
আল্লাহর রাসুল (সা.) দেরি না করে নিজের মুখের বরকতময় পানি সাহাবির হাতে দিয়ে দিলেন। আবদুল্লাহ বাড়িতে ফিরে মুমূর্ষু বাবার সামনে পানির পাত্র তুলে ধরে বললেন, ‘নিন, পান করুন।’
ইবনে উবাই বললেন, ‘এটা কী?’
ছেলে বললেন, ‘রাসুল (সা.)-এর মুখের বরকতময় পানি। হয়তো এর বদৌলতে আপনার মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব হবে। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন!’
ইবনে উবাই পানির পাত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘তাঁর মুখের পানি পান করব না।’
ছেলে প্রচণ্ড রাগে দৌড়ে নবীজি (সা.)-এর দরবারে গিয়ে বললেন, ‘আমার আব্বা ঘোরতর মুনাফিক। আপনি অনুমতি দিন, আমি তাঁর গর্দান কেটে নিয়ে আসি!’
আল্লাহর নবী (সা.) তাঁকে মানা করে বললেন, ‘না, উনি তোমার বাবা। তাঁর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করো। খেদমত করো।’
সাহাবি বাড়ি ফিরে গেলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর মৃত্যুর পর ছেলে আবার দৌড়ে এলেন রাসুল (সা.)-এর কাছে। আবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার আব্বা মারা গেছেন। আপনার গায়ের একটা জামা দেবেন, আব্বার কাফন দেব। হয়তো আপনার জামার বরকতে তাঁর কবরের আজাব মাফ হয়ে যাবে।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) কোনো চিন্তা ছাড়াই নিজের জামাটি আবদুল্লাহর হাতে দিয়ে দিলেন।
রাসুল (সা.)-এর জামা বুকে চেপে ধরে আবদুল্লাহ দৌড়ে বাবার লাশের কাছে চলে এলেন।
তারপর লাশের গোসল দিয়ে কাফন পরানো হলো। জানাজার নামাজ পড়ানোর সময় রাসুল (সা.) এলেন সেখানে। আবদুল্লাহ রাসুল (সা.)-কে দেখে দৌড়ে এসে মিনতি করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আব্বার জানাজাটা আপনি পড়াবেন?’
রাসুল বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ, কেন নয়? অবশ্যই পড়াব।’
রাসুল (সা.) জানাজার নামাজের কাতার সোজা করতে বললেন।
হজরত ওমর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আল্লাহ তাআলার দুশমন উবাইর জানাজা কি আপনি আদায় করবেন, যে অমুক দিন এই কথা বলেছে, অমুক দিন এই কথা বলেছে? মুসলিমদের অরক্ষিত রেখে যে ওহুদের ময়দান থেকে ৩০০ যোদ্ধা নিয়ে ভেগে গিয়েছিল। যে রাসুল (সা.)-কে হত্যা করতে মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছিল। রাসুল (সা.)-কে মদিনা থেকে বের করে দিতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করেছিল। মদিনার মুনাফিকদের এই নেতা হজরত আয়েশা (রা.)-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ রটনাকারী।’
এভাবে ওমর (রা.) একের পর এক নির্দিষ্ট দিন-তারিখ উল্লেখ করতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) মুচকি হাসলেন।
হজরত ওমর (রা.) বললেন, ‘এমনকি আমি যখন নবীজি (সা.)-কে অনেক কিছু বললাম, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে ওমর! আমার সামনে থেকে সরে যাও। আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি তার সম্পর্কে। আমাকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তুমি ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো বা না করো, একই কথা। তুমি ৭০ বার ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ ওদের কখনোই ক্ষমা করবেন না। এ জন্য যে ওরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ৮০)
নবীজি (সা.) বললেন, ‘তবু আমি তার জানাজা পড়ে ক্ষমা চাইব, যদি আল্লাহ মাফ করেন।’
নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি যদি জানতাম, তাদের জন্য ৭০ বারের বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাআলা তাদের ক্ষমা করে দেবেন, তাহলে আমি তা-ই করতাম।’
এটা দেখে ওখানে উপস্থিত মুনাফিকেরা কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আরেকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘ওদের মধ্যে কারও মৃত্যু হলে তুমি কখনো ওর ওপর (জানাজার) নামাজ পড়বে না এবং ওর কবরের পাশে দাঁড়াবে না। ওরা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করেছিল আর সত্যত্যাগী অবস্থায় ওদের মৃত্যু হয়েছে।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ৮৪) (মুসলিম, হাদিস: ৬,৮২৩; তিরমিজি, হাদিস: ৩০৯৮)