আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল | ফাইল ছবি |
বিশেষ প্রতিনিধি: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন ৩০টি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও ২০টি অভিযোগের তদন্ত করছে, যেখানে আসামির সংখ্যা ২০।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বিচারাধীন ৩০টি মামলায় আসামি ১৭২ জন। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা ৫০টির বেশি আপিল এখন সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকেরা নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী নৃশংসতা চালায়। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল বা সরাসরি অংশ নিয়েছিল এদেশীয় কিছু দোসর, যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। সে হিসাবে যাত্রা শুরুর ১৪ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আজ সোমবার।
২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। এরপর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন এই ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম চলছে।
এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪৪টি এবং ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় এসেছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল গতকাল রোববার বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, গত ১৪ বছরে ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এসব মামলায় দণ্ডিত আসামির সংখ্যা ১৪৯। বর্তমানে প্রাক্–বিচার, বিচার ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালে ৩০টি মামলা বিচারাধীন।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দণ্ডিত ১৪৯ আসামির মধ্যে ১০৬ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন এখনো পলাতক।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৮৩৩টি, যার মধ্যে ৮৯টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে।
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিকভাবেও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে চূড়ান্ত বিচারে দণ্ডিতদের আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়া এবং দেশে-বিদেশে পলাতক আসামিদের ধরতে না পারায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে একধরনের হতাশাও রয়েছে।
চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আপিল
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্যমতে, ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ৫০টির বেশি আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। যাঁরা আপিল করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান মো. আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ওরফে ননী ও ওবায়দুল হক, কিশোরগঞ্জের সামসুদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া, মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়া প্রমুখ।
এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে মোবারক হোসেনের করা আপিল গত জানুয়ারিতে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। জানতে চাইলে তাঁর আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, এখনো শুনানি শুরু হয়নি।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় দেন আপিল বিভাগ। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন (রিভিউ) করেন তিনি। পুনর্বিবেচনার আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম সাইফুল আলম।
দণ্ড কার্যকর
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ছয় আসামির মধ্যে পাঁচজনই জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন দলটির তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর।
আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছরের আগস্ট মাসে হাসপাতালে মারা যান। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল বিচারাধীন অবস্থায় কয়েকজন দণ্ডিত আসামি মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ৯০ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াত নেতা আবদুস সুবহান এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম রয়েছেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, গণহত্যার জন্য সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ঘাতক সংগঠনের বিচার দ্রুত শুরু করা দরকার। একই সঙ্গে পাকিস্তানি হাইকমান্ডের বিচারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল সচল করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে আপিল বিভাগে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিতদের আপিল নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।