প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসছে অসংখ্য জেলি ফিশ। যেগুলো মারা গিয়ে পচে–গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি কুয়াকাটা সৈকতসংলগ্ন লেম্বুর চরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি কলাপাড়া: পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় দুই সপ্তাহ ধরে অসংখ্য জেলি ফিশ ভেসে আসছে। এসব জেলি ফিশ শরীরে লাগলেই চুলকানি হচ্ছে। এতে সমুদ্রে মাছ ধরতে নামতে পারছেন না জেলেরা। ভেসে আসা জেলি ফিশ সৈকতে পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলে ভেসে আসা এসব জেলি ফিশ ‘সাদা জেলি ফিশ’ নামে পরিচিত। যার বৈজ্ঞানিক নাম ফাইলোরিজা পাংটাটা (Phyllorhiza punctata)। এরা বিষাক্ত প্রজাতির নয়। তবে এ প্রজাতির জেলি ফিশের কিছুটা চুলকানি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে। সাঁতার কাটতে না পারায় এরা বাতাস-স্রোত বা জোয়ারে সমুদ্র থেকে উপকূলে বা সৈকতে এসে আটকে পড়ে।

সরেজমিনে উপকূল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাতাসের চাপে এবং ঢেউয়ের কারণে জেলি ফিশ সৈকতে আটকে পড়েছে। কুয়াকাটা সৈকত, লেম্বুর চর, গঙ্গামতী, খালগোড়া ও ঝাউবন এলাকার বালুচরে লাখ লাখ জেলি ফিশ পড়ে আছে। এসব জেলি ফিশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র।

এমন অবস্থার কারণে জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরতে পারছেন না। ইতিমধ্যে অনেক জেলে ট্রলার-নৌকা নিয়ে তীরে ফিরে এসেছেন। অনেকে আলীপুর, মহিপুর, কুয়াকাটা, খালগোড়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নৌকা, ট্রলারসহ নোঙর করে বসে আছেন। তবে বেশি বিপাকে পড়েছেন উপকূলের কুয়াকাটা, গঙ্গামতী, খাজুরা, খালগোড়া, মহিপুর ও আলীপুরের খুটা জেলেরা (ইঞ্জিনচালিত ছোট ছোট নৌকার জেলেরা)।

এ বছর বেশি পরিমাণে মরা জেলিফিশ সৈকতে দেখা যাচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) ও সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষজ্ঞ মো. কামরুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বছর আগের এ প্রাণীকে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের যুগের প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। সম্পূর্ণ নরম দেহ বা জিলেটিনাস দেহ নিয়ে এরা গঠিত। জেলি ফিশ প্রকৃতপক্ষে লোনা সাগরের প্রাণী। সাঁতার কাটার জন্য এদের দেহে কোনো শক্তি বা অঙ্গ নেই। তবে পানির গভীর থেকে ওপরে এবং ওপর থেকে গভীরে গমন করতে পারে। পার্শ্বীয় চলাচল বা সমান্তরাল পথ ভ্রমণে এরা মোটেই উপযুক্ত নয়। ফলে স্রোতে সৈকতে এসে আটকা পড়লে আর গভীর সমুদ্রে ফিরতে পারে না।

কামরুল ইসলাম আরও বলেন, মার্চ থেকে জুলাই মাসে সমুদ্রের পানির অক্সিজেন ভালো থাকে। তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা প্রজননের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় সাদা জেলি ফিশ বিস্তরভাবে বংশবিস্তার (পপুলেশন ব্লুমস) করে, যা পরবর্তী সময়ে সাগরের ঢেউ-স্রোত ও বাতাসে সৈকতে চলে আসে। এ কারণে প্রতিবছর মার্চ মাসের শুরুতে বা কিছু ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে এসব জেলি ফিশ উপকূলে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এ সময় সাধারণত জেলি ফিশের আধিক্যের কারণে জেলেরা মাছ ধরার কাজে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হন। তবে তাপমাত্রা কমে গেলে বা সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই এরা মারা যাবে। তবে সাগরে অধিক মাছ আহরণ করার (ওভার ফিশিং) কারণেও জেলি ফিশের বংশবৃদ্ধি হতে পারে। কারণ, অনেক সামুদ্রিক মাছ বা প্রাণী জেলি ফিশ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তাই সাগরে কিছু প্রয়োজনীয় মাছ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবে জেলি ফিশের সংখ্যা বেড়ে যায়।

কুয়াকাটা সৈকত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন মো. জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সৈকত এলাকায় ভেসে আসা জেলি ফিশ কুড়িয়ে বস্তায় ভরে মাটি চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। তবে এগুলো অসংখ্য পরিমাণে হওয়ায় আমরা কয়েকজন মাত্র স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেও কোনো কুল করতে পারছি না। সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে এগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।’

গঙ্গামতী এলাকার জেলে আবদুল মন্নান মাঝি বলেন, ‘আমাগো মতন যেসব জাইল্যা ভাসা জাল বায়, তারা কয়েক দিন ধইর‌্যা সমুদ্রের গভীরে যাইয়া কোনো মাছই ধরতে পারছে না। অনেক জাইল্যা সাগরে গোনে চইল্যা আইছে। এই গুলানের দেহের লগে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেনু পোনা আটকাইয়াও মারা যাচ্ছে। এগুলা এমনই বিষাক্ত, জাইল্যাগো হাতে-পায়ে লাগলেও চুলকায়।’ গত কয়েক বছরে এমন পরিস্থিতি হয়নি বলে উল্লেখ করে জেলে টুনু মিয়া বলেন, ‘এবার হঠাৎ করে সমুদ্রের পানিতে ভেসে আসছে লাখ লাখ জেলি ফিশ। কী যে এক অবস্থা, সমুদ্রে জাল ফালাইলেই জালের সাথে জেলি মাছগুলা লাইগ্যা যায়। এ ছাড়া জালে লাগলে ওজন এত বেশি হয়, জাল তুইল্যা উডান যায় না। জাল পানির নিচের দিকে চইল্যা যায়।’

জেলেরা মাছ ধরতে না পারায় সরবরাহ কমে গেছে বলে মনে করেছেন আলীপুর মৎস্য বন্দরের মেসার্স ধুলাসার ফিশের আড়তদার মো. বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার গভীরে জেলি ফিশ বেশি ভাসছে। গভীর সমুদ্রেও অনেক জেলের জালে জেলি ফিশ আটকে জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে শুনেছি। কোনো খুটা জেলেই সমুদ্রের উপকূলে জাল ফেলতে পারছেন না। এ কারণে ৮০০ থেকে ১ হাজারের মতো খুটা জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন।’

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোফিশ-২ অ্যাকটিভিটির পটুয়াখালী জেলার সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, ‘সমুদ্রে কচ্ছপের আধিক্য কমে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, কচ্ছপের প্রধান খাদ্য হচ্ছে জেলি ফিশ। যদি কচ্ছপের আধিক্য বেশি থাকত, তাহলে হঠাৎ এত পরিমাণে জেলি ফিশের উদ্ভব হতো না। এ ছাড়া সমুদ্রে জলজ বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে জলজ বাস্তুতন্ত্রেরও পরিবর্তন হচ্ছে। জেশি ফিশ বেড়ে যাওয়া তারই একটা বড় প্রমাণ বলে আমরা মনে করতে পারি।’