শহীদ মধুসুদন দে | ছবি: সংগৃহীত |
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের নাম। মধুসূদন দে, যিনি ‘মধুদা’ নামেই বহুল পরিচিত, ছিলেন মধুর ক্যানটিনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের পরদিন সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন মধুদা, তাঁর স্ত্রী, বড় ছেলে ও তাঁর নববিবাহিত স্ত্রী। সবার প্রিয় সেই মধুসূদন দে আজ রোববার বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পেয়েছেন।
আজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ ঘোষণা দেন। বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় মধুসূদন দে বা মধুদার বাবার নাম লেখা হয়েছে আদিত্য চন্দ্র দে, মায়ের নাম যোগমায়া দে। গ্রাম বা মহল্লা-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, থানা-রমনা, জেলা-ঢাকা।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এ দেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যত আন্দোলন হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন-প্রতিটি ক্ষেত্রে মধুসূদন দের ভূমিকা ছিল। তিনি সবাইকে সহযোগিতা করেছেন। তাই শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় না পড়লেও মধুদাকে বুদ্ধিজীবীর তালিকায় রেখেছে সরকার। পেশাগত পরিচয়ের বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমভাবে তাঁকে বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত চার পর্বে ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আজ যুক্ত করা হয় আরও ১১৮ জনের নাম। তাঁদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন শহীদ মধুসূদন দে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় মধুদাকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘মধুদা একজন চায়ের দোকানদার ছিলেন। তিনি সেই সময় বিনা পয়সায় চা খাইয়েছেন। এই একজনকেই আমরা ব্যতিক্রমভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দিয়েছি। তবে এই পরিবার কোনো ভাতা পাবে না।’
শহীদ মধুসূদন দে স্মারক গ্রন্থসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বইপত্র থেকে জানা যায়, মধুর ক্যানটিনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আদিত্য চন্দ্র। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আদিত্য চন্দ্র এখানে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে আদিত্য চন্দ্র মারা যান। এরপর তাঁর ১৯ বছর বয়সী ছেলে মধুসূদন দে ব্যবসার হাল ধরেন। মধুর ক্যানটিনের বর্তমান মালিক মধুসূদন দের ছেলে অরুণ দে।
মধুদার পিতামহ ছিলেন নকরী চন্দ্র। উনিশ শতকের প্রথম দিকে তৎকালীন বিক্রমপুরের (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) শ্রীনগরের জমিদারদের সঙ্গে নকরী চন্দ্রের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে নকরী চন্দ্র সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন। আশ্রয় নেন জমিদারদের জিন্দাবাজার লেনের বাসায়। তাঁর দুই ছেলে আদিত্য চন্দ্র ও নিবারণ চন্দ্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পাশে মধুদার তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় মধুর রেস্তোরাঁ। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের জন্য মধুদা শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় ও বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। মধুর ক্যানটিনে ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল সব সময়ই। এ ছাড়া নিয়মিত আসতেন উদীয়মান ও উঠতি কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড়সহ সৃষ্টিশীল সম্ভাবনাময় তরুণ-যুবকেরা। এভাবে মধুর ক্যানটিন হয়ে ওঠে ছাত্ররাজনীতির সূতিকাগার। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের অলিখিত সদর দপ্তর হয়ে উঠেছিল মধুর ক্যানটিন। মুক্তিযুদ্ধের আগে এই ক্যানটিনে গভীর রাতে বহু রাজনৈতিক বৈঠক হতো। এসব বৈঠকের বিষয়ে ছাত্রনেতাদের বাইরে শুধু মধুদাই অবহিত থাকতেন।
এ বিষয়ে শহীদ মধুসূদন দে স্মারকগ্রন্থ মধুদার মুখবন্ধে সম্পাদনা পরিষদের সদস্য আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘ছাত্র আন্দোলনের সূতিগৃহ হিসেবে মধুর ক্যানটিনের ব্যবহার, ছাত্রদের প্রতি মধুর ভালোবাসা, মধুর প্রতি ছাত্রদের নির্ভরতা ও শ্রদ্ধাবোধ-এসবই শাসকদের দৃষ্টিতে মধুকে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের পরদিন সকালে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়ি আক্রমণ করে। মধুসূদন দে তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে শিববাড়ি কোয়ার্টারে থাকতেন। পাকিস্তানি সেনারা ওই বাসা থেকে তুলে নিয়ে মধুসূদন দে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।
বর্তমানে মধুর ক্যানটিন পরিচালনা করছেন তাঁর ছেলে অরুণ কুমার দে। বাবার স্বীকৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক আগে বাবার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলাম। এখন এই খবর শুনে খুব ভালো লাগছে।’