পঞ্চম উইকেটে ১৬৫ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে জয় এনে দিয়েছেন নাজমুল হোসেন ও মুশফিকুর রহিম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
ক্রীড়া প্রতিবেদক: লাহিরু কুমারার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে কাভার দিয়ে বিদ্যুৎ–গতির চার। শূন্যে ব্যাট তুললেন, হেলমেটে চুমু খেলেন, তারপর বুক চিতিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সোজা হয়ে দাঁড়ালেন নাজমুল হোসেন। শতক উদ্যাপনে ফুটে উঠল সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার গরিমা।
অধিনায়ক জানতেন, এরপর অপেক্ষা মাত্র ৩৮ রানের। স্বল্প এই দূরত্ব পার হলেই মেতে ওঠা যাবে জয়ের উৎসবে। ওয়াডেতে নিজের তৃতীয় শতক উদ্যাপন তাই সীমাবদ্ধ থাকল ওটুকুতেই।
৩৮তম ওভার শেষে ততক্ষণে ২১৮ ছুঁয়েছে বাংলাদেশের রান। ৯২ রানে চতুর্থ উইকেট হারানোর পর মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে বাঁধা জুটি তখনো ১২৬ রানে অবিচ্ছিন্ন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টানা তৃতীয় ওয়ানডেতে ফিফটি করে পরে তিন অঙ্কও ছুঁয়েছেন নাজমুল। মহীশ তিকশানাকে কাভার দিয়ে চার মারা জয়সূচক শটটিও তাঁর ব্যাট থেকেই আসা। এমন দিনে স্বাভাবিকভাবেই আলোটা বেশি কাড়লেন অধিনায়ক। কিন্তু মুশফিককে আড়াল করা কি এত সহজ! নাজমুলের শতক উদ্যাপনে পিঠ চাপড়ে দিতে আসা এই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের বিস্তৃত হাসি বলে দিচ্ছিল, আনন্দ করার পূর্ণ অধিকার দাবি করে তাঁর ৮৪ বলে অপরাজিত ৭৩ রানের ইনিংসটিও।
পূর্ণ মেয়াদে তিন সংস্করণের অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর এটাই ছিল নাজমুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে। শুরুটা হলো দারুণ এক জয়ে। টি-টোয়েন্টির খরস্রোতা সময়কে পেছনে ফেলে ব্যাট হাতে ধরে রাখলেন ওয়ানডের ব্যাটিংয়ে নিজের সাফল্যটাও। আর ১২২ রানে অপরাজিত থেকে গড়লেন রেকর্ডও। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ ইনিংস।
১২২*
নাজমুল হোসেনের ১২২ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোনো অধিনায়কের সর্বোচ্চ। আগের সর্বোচ্চ মুশফিকুর রহিমের ১১৭, ২০১৪ সালে ফতুল্লায় ভারতের বিপক্ষে।
জয় অনেক কিছুই ঢেকে দেয়। তার ওপর সেই জয়ে যদি থাকে নাজমুলের ১২৯ বলে অপরাজিত ১২২ ও মুশফিকের ৮৪ বলে অপরাজিত ৭৩ রানের ইনিংসের মতো দুটি অলংকার এবং দুজনের ১৭৫ বলে ১৬৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি, তাহলে কে আর পেছন ফিরে তাকায়? সব ভুলত্রুটি তো ওখানেই মাফ!
কিন্তু না তাকালে যে এই দুজনের জুটির মাহাত্ম্যটাই বোঝা যাবে না! ২৫৫ রান তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল হোঁচট খেতে খেতে। দিলশান মাদুশঙ্কার করা ইনিংসের প্রথম বলেই বোল্ড ওপেনার লিটন দাস। এরপর ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলের মধ্যে ১৪ ও ২৩ রানে ফেরেন সৌম্য সরকার আর তাওহিদ হৃদয়। চতুর্থ উইকেটে নাজমুল-মাহমুদউল্লাহর ৬৯ রানের জুটি কিছুটা স্থিরতা দিল। ৩৭ বলে ৩৭ করে নাজমুলের সঙ্গে দারুণভাবে কাঁধ মিলিয়েছেন অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ।
৯২ রানে তিনিও ফিরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য বাকি গল্পটা হতে পারত বিপর্যয়ের। কিন্তু নাজমুল-মুশফিকের সাহসী জুটিতে উল্টো সেখান থেকেই মাথা তুলে দাঁড়াল বাংলাদেশ। বাকিটা তো ইতিহাস!
শ্রীলঙ্কার বোলিং এরপর আর কখনোই বাংলাদেশের ওপর চেপে বসতে পারেনি। তবে বাজে বলকে যেমন শাস্তি দিয়েছেন, ভালো বলগুলোও তেমনি ঝুঁকি এড়িয়ে নীরবে পার করে দিয়েছেন নাজমুল-মুশফিক। সে রকমই একটা পর্যায়ে ১০ ওভারের মতো কোনো বাউন্ডারি আসেনি বাংলাদেশের ইনিংসে। ২২.৪ ওভারে হাসারাঙ্গাকে চার মেরেছিলেন মুশফিক। পরের চারটি আসে ৩২.৫ ওভারে। মুশফিকেরই রিভার্স সুইপে সেটিও হাসারাঙ্গার বলেই। শ্রীলঙ্কার যে লেগ স্পিনার হতে পারতেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য বড় হুমকি, ৮ ওভারে ৫৪ রান নিয়ে বাংলাদেশ আজ তাঁকেই দেয়নি কোনো উইকেট।
ম্যাচের আগে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের কোনো উইকেটকেই আলাদা করে চেনার উপায় ছিল না। সব প্রায় একই রকম সবুজ। স্টাম্প আর সাদা রঙে পপিং ক্রিজের দাগ টানা না থাকলে সাগরিকার সব উইকেট যেন যমজ ভাই!
ম্যাচ শুরুর আগে ধারাভাষ্যকার রাসেল আরনল্ডের পিচ রিপোর্ট উইকেট সম্পর্কে আরেকটু ধারণা দিল। পিচ বেশ শক্ত, ঘাস আছে। চট্টগ্রামের উইকেট অনেকটা সিলেটের মতোই রানপ্রসবা হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল সাবেক এই লঙ্কান ক্রিকেটারের।
কিন্তু এমন উইকেটে আগে ব্যাটিং করেও শ্রীলঙ্কার ইনিংসটা ২৫৫-এর বেশি যেতে পারল না। অথচ দুই ওপেনার আভিস্কা ফার্নান্ডো আর পাতুম নিশাঙ্কা যেভাবে শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রান তাড়ার চ্যালেঞ্জটা কঠিনই হতে যাচ্ছে।
টসে জিতে শ্রীলঙ্কা প্রত্যাশিতভাবে ব্যাটিংই নেয়। শরীফুল ইসলাম প্রথম ওভারটা খারাপ করেননি। কিন্তু ইনিংসের দ্বিতীয় ও নিজের প্রথম ওভার করতে এসেই আরেক পেসার তাসকিন আহমেদ দিয়ে দিলেন ১২ রান। শুরুর দিকে দুই পেসারের অনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সুবিধা নিচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কান দুই ওপেনার। ৬ ওভারেই আসে ৪১ রান। শরীফুলের শর্ট বলে আভিস্কার ছক্কায় দলের রান ৫০ হয়ে যায় পরের ওভারেই। দশম ওভারের পঞ্চম বল পর্যন্ত একসঙ্গে থেকে তাঁরা গড়েন ৭১ রানের জুটি।
কখনো কাভার দিয়ে, কখনো বোলারের মাথার ওপর দিয়ে মারা ড্রাইভে, কখনোবা হুক-পুলে মারা বাউন্ডারিতে ইনিংসের অষ্টম ওভার পর্যন্ত বোলারদের শাসিয়েই যান আভিস্কা ও নিশাঙ্কা। অষ্টম ওভারে নিজের প্রথম ওভার করতে এসে প্রথম ও শেষ বলে তানজিম হাসানও দুটি চার খেয়ে যান তাঁদের ব্যাটে।
তবে ১ ওভার বল করেই যেন তিনি পড়ে ফেলেন এমন পিচে উইকেট নেওয়ার সূত্রটা। দশম ওভারের পঞ্চম বলটা শরীরের অনেক বাইরে খেলালেন আভিস্কাকে। সেটাতেই চড়াও হতে গিয়ে কট বিহাইন্ড লঙ্কান ওপেনার। প্রথম ধাক্কা খেয়ে নড়বড়ে শ্রীলঙ্কা উইকেট হারিয়েছে তানজিমের পরের ২ ওভারেও। ১২ নম্বর ওভারের প্রথম বলে গালিতে অদ্ভুত ক্যাচ দিয়ে নিশাঙ্কা ও ১৪ নম্বর ওভারের প্রথম বলে সামারাবিক্রমা ফিরে যান ড্রেসিংরুমে।
তানজিমের তিন ধাক্কার পর শ্রীলঙ্কা শুরুর গতিটা আর ফিরে পায়নি। বরং শুরুর এলোমেলো বোলিং থেকে বেরিয়ে এসে শরীফুল, তাসকিনও নেন ৩টি করে উইকেট। তবে দুর্ভাগ্য তানজিমের। নিজের নবম ওভার বোলিংয়ের সময় পায়ে চোট পেয়ে ওভার অসমাপ্ত রেখেই মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে।
অধিনায়ক কুশল মেন্ডিসের ৭৫ বলে ৫৯ ও পরে জানিথ লিয়ানাগের ৬৯ বলে ৬৭ রানে শ্রীলঙ্কা অলআউট হওয়ার আগে করতে পেরেছে ২৫৫ রান। সেটি যে মোটেও যথেষ্ট ছিল না, ম্যাচের শেষ দৃশ্যের অনেক আগেই জানা হয়ে যায় তা। জানিয়ে দেয় নাজমুল আর মুশফিকের অনবদ্য ব্যাটিং।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা: ৪৮.৫ ওভারে ২৫৫ (নিশাঙ্কা ৩৬, আভিস্কা ৩৩, মেন্ডিস ৫৯, সামারাবিক্রমা ৩, আসালঙ্কা ১৮, লিয়ানাগে ৬৭, হাসারাঙ্গা ১৩, তিকশানা ১, মাদুশান ৮, কুমারা ৫*, মাদুশঙ্কা ০; শরীফুল ৯.৫–১–৫১–৩, তাসকিন ১০–১–৬০–৩, তানজিম ৮.৪–০–৪৪–৩, তাইজুল ৮–০–৫৪–০, মিরাজ ১০–১–৩৩–১, সৌম্য ২.২–০–১১–০)।
বাংলাদেশ: ৪৪.৪ ওভারে ২৫৭/৪ (লিটন ০, সৌম্য ৩, নাজমুল ১২২*, তাওহিদ ৩, মাহমুদউল্লাহ ৩৭, মুশফিক ৭৩*; মাদুশঙ্কা ৮–১–৪৪–২, মাদুশান ৮–০–৫৩–১, কুমারা ৬–০–৩৫–১, তিকশানা ৯.৪–০–৪৭–০, হাসারাঙ্গা ৮–০–৫৪–০, লিয়ানাগে ৫–০–২২–০)।
ফল: বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: নাজমুল হোসেন।