এসব ইউটিউব চ্যানেল ভুয়া ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব | ছবি: ডিসমিসল্যাবের সৌজন্যে |
সুহাদা আফরিন: শুরুতে চাকরিসংক্রান্ত বার্তা ও শিক্ষামূলক বার্তা দিয়ে ভিডিও প্রচার করত ইউটিউব চ্যানেলগুলো। অনুসারীও খুব বেশি ছিল না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর থেকে মিথ্যা ও অপতথ্যে ভরপুর ভিডিও প্রচারে নামে তারা। অনুসারীও হু হু করে বেড়ে যায়। তথ্যের সত্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব বলেছে, এসব চ্যানেল অপতথ্য ও মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে মুনাফা করছে।
সম্প্রতি ডিসমিসল্যাব ‘ইউটিউবে সস্তা-মিথ্যার জমজমাট ব্যবসা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকিং (তথ্যের সত্যতা যাচাই) সংস্থাগুলোর ফ্যাক্ট চেকিংয়ের আওতায় আসা সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো তিনটি ইউটিউব চ্যানেলকে বেছে নেওয়া হয়েছে। চ্যানেল তিনটি হচ্ছে—‘সবাই শিখি’, ‘তাজা নিউজ’ ও ‘মিডিয়া সেল ২৪’।
ডিসমিসল্যাব বলছে, এসব চ্যানেলের ভিডিওগুলো দেখলেই মনে হবে ভুয়া ও সস্তা। ভিডিওর থাম্বনেইল (সামনের চিত্র) ও শিরোনামের সঙ্গে ভেতরের বিষয়বস্তুর মিল নেই। ইউটিউবে এ ধরনের সস্তা–মিথ্যার (চিপফেইক) একটি বাজার গড়ে উঠেছে। যেখানে ভিউ (কতবার দেখা হয়েছে) ও অনুসারী দ্রুত বেড়ে চলেছে। এ ধরনের চ্যানেলগুলো আবার ভেরিফায়েডও।
সবাই শিখি, তাজা নিউজ ও মিডিয়া সেল ২৪—তিনটি চ্যানেল ইউটিউবে রাজনৈতিক ভুয়া তথ্য প্রচারের মাধ্যমে আয় করছে। চ্যানেলগুলো বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখেছে যে তারা যখন থেকে ভুল বা অপতথ্যভিত্তিক ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেছে, তখন থেকেই তাদের ভিউ ও অনুসারী সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ বা তিন গুণের বেশি বেড়েছে। তিনটি চ্যানেলের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে। সেখান থেকে ইউটিউবও মুনাফা করেছে।
মনিটাইজেশন পদ্ধতির মাধ্যমে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ ও ইউটিউব চ্যানেল আয় করে থাকে। মনিটাইজেশন হচ্ছে চ্যানেলকে আয়যোগ্য করে তোলা। মনিটাইজেশন সুবিধা চালু করতে হলে ইউটিউব চ্যানেলে কমপক্ষে ৫০০ অনুসারী থাকতে হবে। এ ছাড়া বিগত ১২ মাসে দর্শকদের ভিডিও দেখার সময় ৩ হাজার ঘণ্টা থাকতে হবে। পাশাপাশি আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি ভিডিও আপলোড করতে হবে।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করা ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের একটি প্রকল্প হচ্ছে ডিসমিসল্যাব। এর প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ইউটিউবের মনিটাইজেশন পদ্ধতিতে সমস্যা রয়েছে। তারা অপতথ্য দিয়ে ব্যবসা করছে। তাদের এনফোর্সমেন্ট (বাস্তবায়ন) নীতি যথাযথ না। কোনো ভিডিও নিয়ে রিপোর্ট করলে (আপত্তি জানালে) দ্রুত তারা পদক্ষেপ নেয় না।’
ডিসমিসল্যাব বলছে, ইউটিউবের নির্দেশাবলিতে (কমিউনিটি গাইডলাইন) থাম্বনেইল পলিসিতে বলা হয়েছে, ভিডিওর থাম্বনেইলে এমন কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না, যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু উল্লিখিত তিনটি চ্যানেলের ভিডিওতে বিভ্রান্তিকর থাম্বনেইল ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে এমন তথ্যের উল্লেখ আছে, যা সত্য নয় এবং ভিডিওতে তেমন কোনো তথ্য উপস্থাপনও করা হচ্ছে না। কিন্তু ভিডিওগুলো ইউটিউবে রয়েছে এবং মনিটাইজেশনের মাধ্যমে মুনাফা করছে।
মিডিয়া সেল ২৪ চ্যানেলটি ঘেঁটে দেখা যায়, একটি ভিডিওর শিরোনাম ‘মুক্তি পাচ্ছে মির্জা ফখরুল...তফসিল বাতিল।’ সেটি প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। অথচ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখনো কারাগারে ছিলেন এবং নির্বাচনী তফসিলও বাতিল হয়নি। তাতে বিভিন্ন সময়ের ভিডিও জোড়া দেওয়া হয়েছে। এর ভিউ হয়েছে ১০ লাখের মতো। সাড়ে চার শতাধিক মন্তব্য করা হয়েছে তাতে। মিডিয়া সেল ২৪ চ্যানেলটি ভেরিফায়েডও।
সবাই শিখি নামের চ্যানেলটি থেকে গত ২ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনামে আছে, ‘জরুরি ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি’। সেখানেও বিভিন্ন সময়ের টুকরো টুকরো ভিডিও জোড়া দিয়ে একটি কনটেন্ট বানানো হয়েছে, যার কোনো সত্যতা নেই।
কোন চ্যানেল ইউটিউবে আয় করছে আর কোনগুলো করছে না—সে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও ইউটিউব স্বচ্ছ নয়। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরের আগে কোনো চ্যানেলের মনিটাইজেশন–সংক্রান্ত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। চ্যানেলের সোর্স কোডে গিয়ে দেখা যেত মনিটাইজেশনের মাধ্যমে তারা আয় করছে কি না। কিন্তু ইউটিউব এখন আর তা দেখায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ইউটিউবের সমস্যাটি বৈশ্বিক। তাদের যথাযথ কোনো ফ্যাক্ট চেকিং পদ্ধতি নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকে অপতথ্য সরানো হলেও ইউটিউবে তা থেকে যাচ্ছে।
সুমন রহমান আরও বলেন, ‘এতে অন্যান্য প্ল্যাটফর্মসহ মূলধারার গণমাধ্যমও সমস্যায় পড়ে। কারণ, ভিডিওগুলো নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ সহজেই এখন এসব প্ল্যাটফর্মের তথ্য বিশ্বাস করে এবং অপতথ্যের মাধ্যমে ভুল তথ্য সমাজে ছড়িয়ে যায়। ইউটিউবকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য যেসব দেশ অপতথ্যের সমস্যায় ভুগছে, তাদের একসঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে।’