ড. মোহাম্মদ এ রহমান: অ্যানেসথেসিয়া নিয়ে কয়দিন আগে দেশে যে তোলপাড় হলো, তাতে একটা উপকার হয়তো হলো। অ্যানেসথেসিয়া বিষয়টা কী এবং এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেটা মানুষ কিছুটা হলেও বুঝতে পারল। যদিও তাতে স্বজন হারানো মানুষের বেদনা একটুও কমবে না, বরং হয়তো বাড়বে। কেন একজন দক্ষ অ্যানেসথেটিস্ট ছিল না সেই প্রিয়মুখটিকে বেঁচে থাকার মতো নিশ্বাস দিতে!

অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্য দশটা বিষয়ের মতোই একটা বিষয়। কম জটিল নয়, আবার বেশি কঠিনও নয়। অন্য সব বিষয়ে (ধরুন মেডিসিন, সার্জারি, কার্ডিওলজি ইত্যাদি) যেমন বেশ কয়েক বছর প্রশিক্ষণ, বিস্তর লেখাপড়ার সঙ্গে হয়তো খানিকটা গবেষণা, বেশ কঠিন কিছু পরীক্ষায় পাস করে বিশেষজ্ঞ হতে হয়, অ্যানেসথেসিয়াতেও তা–ই।

একইভাবে অন্য বিষয়ে যেমন বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন না করেও ‘বিশেষভাবে অভিজ্ঞ’ পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ প্র্যাকটিস (ব্যক্তিগত রোগী দেখা) করেন, এখানেও তা দেখা যায়। সামান্য কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্য হলো, অ্যানেসথেসিয়া দিতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললে সেটা শোধরানোর জন্য সময় বড্ড কম পাওয়া যায়।

সাধারণভাবে অ্যানেসথেসিয়ার প্রয়োগ অত্যন্ত নিরাপদ। সেটা হোক পূর্ণ অ্যানেসথেসিয়া কিংবা আংশিক। কোনো রোগীর জন্য অ্যানেসথেসিয়া কতটা নিরাপদ, সেটা সেই রোগী অস্ত্রোপচারের আগে আগে সাধারণভাবে কতটা সুস্থ, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। রোগীর সুস্থতা কয়েকটা পর্যায়ের হতে পারে।

গ্রেড ১ থেকে ৫ পর্যন্ত। গ্রেড ১ মানে রোগী খুবই সুস্থ, গ্রেড ৫ মানে মুমূর্ষু। এটা অত্যন্ত সহজেই বোধগম্য যে অ্যানেসথেসিয়ায় ঝুঁকির মাত্রা রোগীর সুস্থতার গ্রেড ১ থেকে ৫ পর্যন্ত আস্তে আস্তে বাড়বে। গ্রেড ১-এ যেখানে রোগীর ঝুঁকি অত্যন্ত কম, গ্রেড ৫-এ সেখানে রোগীর অ্যানেসথেসিয়া বা সার্জারি করে (অথবা না করে) বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের (ধরুন গ্রেড ১ বা ২ পর্যায়ের সুস্থ) অ্যানেসথেসিয়া থেকে কোনো একটা মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা কেমন? এককথায় এই আশঙ্কা অত্যন্ত কম। এতটাই কম যে আপনি অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগে রাজি হতে একটুও দ্বিধা করবেন না। ঢাকা শহরে রাস্তা পার হওয়াও হয়তো এর চেয়ে কম নিরাপদ।

এভাবে তুলনা করাটা যদিও ঝুঁকিপূর্ণ। রাস্তা যতই অনিরাপদ হোক, সেখানে অনেক কিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আপনি রাস্তাটা দেখেশুনে পার হবেন, নাকি চোখ বন্ধ করে ঝেড়ে দৌড় দেবেন, সেটা আপনি ঠিক করতে পারেন। অ্যানেসথেসিয়ায় আপনি দায়িত্বটা অন্য একজনের হাতে সমর্পণ করেন। যাঁর হাতে সমর্পণ করেন, তাঁকে আমরা অ্যানেসথেটিস্ট নামে জানি। তাহলে অ্যানেসথেটিস্ট একটা অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব পালন করেন, সেটা তো বলাই যায়!

বাংলাদেশে অন্য সব বিষয়য়ের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানেও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অনেক ঘাটতি আছে।

অ্যানেসথেসিয়ার মতো বিশেষায়িত চিকিৎসায় ঘাটতিটা একটু বেশি। দেশে বিশেষজ্ঞ অ্যানেসথেটিস্ট খুব বেশি নেই, এটা সত্য। সম্ভবত আরও বেশি সত্য, দেশে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার মতো ভালো বন্দোবস্তও নেই। অ্যানেসথেসিয়া নিরাপদে প্রয়োগ করার জন্য কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়।

একটি ভালো মানের অ্যানেসথেসিয়া মেশিন থাকাটা অত্যাবশ্যকীয়। সঙ্গে থাকতে হবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন রকম সার্কিট, হরেক রকমের টিউব; সেই টিউব শ্বাসনালিতে প্রবেশ করানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের লরিঙ্গোস্কোপ ও উঁচু মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ওষুধ। আরও অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি অপারেশন থিয়েটারে থাকবে, যেগুলোর ব্যবহার শুধু একজন প্রশিক্ষিত অ্যানেসথেটিস্টই জানবেন। সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে একজন দক্ষ সহকারী।

বড় কয়েকটা হাসপাতাল বাদ দিলে বাকি জায়গাগুলোতে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই অনুষঙ্গগুলোর বেশির ভাগই নেই। উপরন্তু, এই সমস্ত অনুষঙ্গ শুধু থাকলেই হবে না, এগুলো প্রতিদিন (ঠিকই পড়েছেন, প্রতিদিন!) পরীক্ষা করে দেখাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপারটা অনেকটা একজন পাইলটের বিমান চালানোর মতো।

আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, একজন পাইলট বিমান পুরোপুরি পরীক্ষা করে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে বিমান ওড়াতে পারেন? তাহলে আপনি এটাও আশা করেন না যে একজন অ্যানেসথেটিস্ট মেশিনপত্র পুরোপুরি পরীক্ষা না করে আপনাকে অ্যানেসথেসিয়া দেবেন।

শুরুতে যে বলেছিলাম, অ্যানেসথেসিয়ার প্রয়োগ ভীষণ নিরাপদ, সেটা প্রযোজ্য হবে এই শর্তগুলো সব পালন করলে। একটা নিরাপদ পরিবেশে অ্যানেসথেসিয়া ততটাই নিরাপদ, যতটা এই আধুনিক যুগে বিমানে ভ্রমণ করা।

তাহলে এর বিপরীতটাও সত্য? অনিরাপদ পরিবেশে অ্যানেসথেসিয়া লক্কড়ঝক্কড় বিমানে উঠে বসার মতোই হবে? সেই বিপরীতটাই ঘটেছিল ঢাকা শহরের দুর্ভাগা শিশু দুটির ভাগ্যে।

আপনার স্বাস্থ্যব্যবস্থা যত দুর্বলই হোক, সমাজের সর্বস্তরের মতো চিকিৎসাসেবায়ও যতই ঘাটতিই থাকুক, খতনা করাতে দুটি শিশুর মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতির জন্য কোনো অজুহাতই থাকতে পারে না। এটা প্রায় নিঃসন্দেহে অবহেলাজনিত মৃত্যু। খুব সামান্য ঝুঁকি নিয়েই এটা আমি বলতে পারি।

তো এই পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। শুধু এক-দুজন মানুষও এর জন্য দায়ী নন। দেশে চিকিৎসা-শিক্ষা খাতে স্বাধীনতার পর থেকে টেকসই বিনিয়োগ কতটা হয়েছে, সেটা রাষ্ট্রের এই দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।

তবে মোটাদাগে এই খাতে বিনিয়োগ বলতে জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজের জন্য শত শত ভবন বানানো। যত দরপত্র, তত টাকা কামাই; শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ গোল্লায় যাক। গবেষণার কথা আর নাই–বা বললাম। এর মধ্যে অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ের অবস্থাটা পদ্মা নদীর কুবের মাঝির মতো। গরিবের মধ্যে সে আরও গরিব।

এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় শেখা ও শেখানোর জন্য আমরা একটা স্বাধীন দেশে এ পর্যন্ত কী কী করেছি? এর মধ্যেও আমরা যা কিছু শিখতে পেরেছি, সেটা খুব নিবেদিতপ্রাণ কিছু অগ্রজ শিক্ষকের নিরলস প্রচেষ্টার জন্য। কিন্তু অ্যানেসথেসিয়ার নিরাপদ প্রয়োগের জন্য দেশে এ পর্যন্ত বলার মতো কোনো কাজই হয়নি। সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা প্রশিক্ষিত অ্যানেসথেটিস্টদের নিয়মিত তদারকির কোনো ব্যবস্থাও নেই। খুব অপ্রতুল প্রশিক্ষণ (ধরুন মাত্র ছয় মাস) নিয়েও কেউ কেউ কাজ করছেন।

সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের জন্য অনেক সময় কোনো অ্যানেসথেটিস্টই থাকেন না। অনেক ক্ষেত্রে যিনি সার্জারি করছেন, তিনিই অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে বসেন, যাঁর এই বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণই নেই। সৌভাগ্যবশত খুব কম সার্জনই এ কাজ করেন।

অনেক জায়গাতে অপারেশন থিয়েটারের সহকারী (অনেক ক্ষেত্রে ওটি বয় হিসেবেও পরিচিত) অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে ফেলেন। ক্লিনিক মালিক নিজে, যিনি হয়তো এক সময় অপারেশন সহকারী ছিলেন, তিনিও অ্যানেসথেটিস্টের কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। এভাবেই চলছে।

একজন চিকিৎসক হিসেবে এটা বলা আমার জন্য অত্যন্ত লজ্জার যে, তাঁরা এই কাজ করেন অ্যানেসথেটিস্টকে যে টাকাটা দিতে হবে, সেটা নিজের পকেটে পুরে নেওয়ার জন্য।

অ্যানেসথেটিস্টকে কত টাকা ফি দেওয়া হবে, কোনো এক বিচিত্র কারণে সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সার্জন ঠিক করে দেন। রোগীর অপারেশনের মোট খরচের সেটা একটা ক্ষুদ্র অংশ।

সংখ্যায় খুব কম হলেও কেউ কেউ সেই টাকাটাও মেরে দিয়ে রোগীকেই মৃত্যুঝুঁকির দিকে ঠেলে দেন। আর রোগী যদি মরেই যায়, বাংলাদেশে জীবনের দাম আর কতো! এখানে টাকা খরচ করলে সব কিছুই ম্যানেজ হয়ে যায়। ফলে আলাদাভাবে অ্যানেসথেসিয়া বা অ্যানেসথেটিস্টের পেছনে পয়সা নষ্ট কেন?

ঘুম পাড়ানো বা সিডেশন আর অ্যানেসথেসিয়া একটু আলাদা হলেও মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।

অনেক প্রসিডিউরে (ধরুন এন্ডোস্কোপি) স্বল্প মাত্রায় সিডেশন দিতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যানেসথেটিস্টের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়া (রিমোট সুপারভিশনে) প্রশিক্ষিত নার্সও স্বল্প মাত্রায় সিডেশন প্রয়োগ করতে পারেন (সেই নার্সকে আসলেই প্রশিক্ষিত হতে হবে, শুধু দেখে শেখা নয়)। যিনি প্রসিডিউর করছেন, তিনি নিজেই সিডেশন দেবেন, সেটা হতে পারে না।

মনে রাখতে হবে, ঘুম পাড়ানোর জন্য আপনি যে ওষুধটা ব্যবহার করছেন (ধরুন মিডাজোলাম), মাত্রার সামান্য হেরফেরে সেটাই হয়ে যাবে অ্যানেসথেসিয়ার প্রয়োগ।

দেশে চিকিৎসা পেশায় শৃঙ্খলা খুব কম। কার্যকর কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেই। সুতরাং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে রেফারেলেরও ব্যাপার নেই। গরিব মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে কিংবা দালালের খপ্পরে পড়ে মানুষ আনাচকানাচে গলিঘুপচিতে অচিন্তনীয় নিম্নমানের কোনো হাসপাতালে প্রিয়জনকে অপারেশন করাতে নিয়ে যান। যেখানে মানসম্মত নিরাপদ অ্যানেসথেসিয়া আকাশকুসুম কল্পনা।

অনেক বছর আগে অনিরাপদ অ্যানেসথেসিয়া দিতে গিয়ে মস্তিষ্ক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া একটি আট–নয় বছরের শিশুর চিকিৎসায় জড়িত ছিলাম। শিশুটির মায়ের একটা কথা এখনো কানে লেগে আছে, ‘আধা ঘণ্টার কথা বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল। সেই আধা ঘণ্টা আর শেষই হলো না।’
এত মায়ের দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে কোনো জাতি বড় হতে পারে না।

 লেখা: অ্যানেসথেসিয়া–বিষয়ক পরামর্শক, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, যুক্তরাজ্য