নওগাঁয় ১৩২টি বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেছে একুশে পরিষদ নওগাঁ। গতকাল সকালে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় মাঠে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি নওগাঁ: একাত্তরে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পুরো বাংলাদেশ ছিল বধ্যভূমি। পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা নিরস্ত্র বাঙালিকে যেখানে যেভাবে পেরেছে, হত্যা করেছে। কিন্তু কোথাও কি লেখা হয়েছে সেই সব শহীদের নাম, তাঁদের আত্মত্যাগের বিবরণ? ২০১০ সালে কঠিন ও শ্রমসাধ্য এই কাজে হাত দেন একুশে পরিষদ নওগাঁর কর্মীরা। জ্ঞানে-অজ্ঞানে ঝাপসা হয়ে আসা বা ঝাপসা করে দেওয়া অধ্যায়গুলোকে তাঁরা একে একে তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষের কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে।

এক যুগের বেশি সময় ধরে ১৯৭১ সালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ। সংগঠনটির কর্মীরা এ পর্যন্ত জেলার ১৩২টি গণহত্যা ও ৬০টি বধ্যভূমির বিবরণ নথিবদ্ধ করেছেন। একুশে পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এসব গণহত্যায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন।

একুশে পরিষদের কর্মীদের নিজস্ব অনুসন্ধানে সংগৃহীত তথ্য উপাত্ত-উপাত্ত আর ভাষ্য নিয়ে ২০১৯ সালে গণহত্যা ১৯৭১: নওগাঁ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ে ৬৭টি গণহত্যার বিবরণ নথিবদ্ধ করা হয়। চলতি বছর বইটির আরেকটি সংস্করণ বের হবে। এই সংস্করণে নতুন আবিষ্কৃত গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি ও গণকবরের বিবরণ যুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও গবেষক দলের নেতা মোস্তফা আল মেহমুদ রাসেল শোনালেন তাঁদের মাঠের কাজের অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধকতার গল্প। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের কাজটি করতে হয়েছে এবং এখনো করে যাচ্ছি। প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ঘটনার সাক্ষী ছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই আর বেঁচে নেই। যাঁরা বেঁচে আছেন, সময়ের প্রবাহে ও বয়সের ভারে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। দ্বিতীয়ত, অনেকেই ইচ্ছা করে বা অজ্ঞতায় ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন।’

২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত ও জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে একুশে পরিষদ নওগাঁ ১৯৭১ সালে নওগাঁয় সংগঠিত ১৩২টি গণহত্যা স্থানের মাটি সংগ্রহ করে শ্রদ্ধার্ঘ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গতকাল সোমবার সকাল আটটায় শহরের মুক্তির মোড়ে অবস্থিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলকের দক্ষিণ পাশে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

২০১০ সাল থেকে গবেষণা শুরু করে এ পর্যন্ত নওগাঁয় ১৩২টি গণহত্যার স্থানের সন্ধান পেয়েছেন বলে জানান সংগঠনের সভাপতি ডিএম আবদুল বারী। তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে নওগাঁয় ৩৯টি বধ্যভূমির উল্লেখ থাকলেও আমাদের তথ্য ও উপাত্ত অনুযায়ী নওগাঁয় প্রকৃত বধ্যভূমির সংখ্যা ৬০। এখনো প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। শুধু বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থান চিহ্নিত করেই আমরা কাজ শেষ করছি না, গণহত্যার তারিখে ওই স্থানে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আলোচনা, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ নানা কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে একুশে পরিষদ স্থানটিকে নতুন প্রজন্মের কাজে তুলে ধরছে।’

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিট ও একুশে পরিষদ নওগাঁ সূত্রে জানা যায়, ৬০টি বধ্যভূমির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছয়টি, সরকারি স্থানীয় দপ্তরের অধীনে একটি, স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অর্থে একটি, একুশে পরিষদ নওগাঁর উদ্যোগে একটি এবং শহীদ পরিবারের সন্তানদের উদ্যোগে ৯টি বধ্যভূমিতে সীমানাপ্রাচীর ও স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বাকি ৪২টি বধ্যভূমি এখনো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে অযত্নে-অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে এসব বধ্যভূমি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রায় অর্ধশত গণকবর রয়েছে নওগাঁয়। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও অনেক গণকবরই সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রশাসনের দায়িত্ব।’