গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. আব্দুল ওয়াদুদ। শনিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার বড় মসজিদ চত্বরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: রাজশাহীতে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদের সংবর্ধনা সভায় রাজশাহীকে ‘মুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছে। রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এই ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘এই ঘোষণার একটি মর্মার্থ রয়েছে।’
সভায় বেশির ভাগ বক্তার বক্তব্যে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। যদিও কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করেননি। এসব বক্তব্যের ব্যাপারে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘তারা যা করছে, ভবিষ্যৎ তার উত্তর দেবে। আর দলাদলি করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী করেননি।’
আবদুল ওয়াদুদ রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সংসদ সদস্য। ১ মার্চ তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এ জন্য আজ শনিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার বড় মসজিদ চত্বরে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে তাঁকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ওমর ফারুক চৌধুরী। ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য দিতে উঠেই বলেন, ‘আজ থেকে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ মুক্ত বলে ঘোষণা করা হলো। রাজশাহীর আকাশে যে অমাবস্যা ছিল, সব সময়ই অমাবস্যা, সব সময়ই সূর্যগ্রহণ, আজকে থেকে আর কোনো সূর্যগ্রহণ রাজশাহীর আকাশে কাজ করবে না। আমরা করতে দেব না। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার সৈনিক। আমরা আওয়ামী লীগকে সমস্ত রকম অন্যায়–অবিচার থেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম।’
মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের প্রতি ইঙ্গিত করে ওমর ফারুক চৌধুরী আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আজকে সকল মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এবং একে (রাজশাহী) মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হলো। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী মাথা উঁচু করে চলবে। কারণ, জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তিনি ছাড়া আর কোনো বাঘ আমরা দেখতে চাই না। আমরা মাননীয় মন্ত্রীর (প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ) নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে একসঙ্গে পথ চলব এবং আমরা শহর ও জেলাতে সবার জন্য জাস্টিস কায়েম করব। কারও একক নেতৃত্বের এলাকা এই রাজশাহী নয়। সুতরাং আমরা এটি মানব না। আমরা আজকে প্রথম ট্রায়াল করলাম এবং এরপরে আমরা আরও অনেক কিছু দেখাব বলে প্রত্যাশা করছি।’
সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিনও তাঁর বক্তব্যে মেয়র লিটনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘একক নেতৃত্বে রাজশাহী সংগঠিত হয়নি। তিনি একটি জিনিস বিশ্বাস করতে পারেন না যে আমার সঙ্গে থাকলে সে সঙ্গী, আর না থাকলে সে জঙ্গি হয়ে যাবে। এই মনোভাব রাজশাহীতে আছে। আমার সঙ্গে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোক হয়, আর আমার সঙ্গে না থাকলেই রাজাকারের সন্তান হয়, এইটি কিন্তু রাজশাহীতে আছে।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-২ (সদর) আসনের নৌকার প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশার বিপরীতে কাঁচি মার্কার দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানোর প্রসঙ্গ তুলে আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীতে যখন নৌকা তুলে দেন, তখন সবার হাতে কাঁচি তুলে দেওয়া হয়। কাঁচি দিয়ে এমন কাটা কাটতে শুরু করেছে যে বিরক্ত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার পরে এই প্রথম রাজশাহীতে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি দেননি।’
মো. আবদুল ওয়াদুদ প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় তাঁকে গণসংবর্ধনা দেয় রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। শনিবার বিকেলে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার বড় মসজিদ চত্বরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-২ আসনে কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান ওরফে বাদশা। তিনি ৩৪ হাজার ৯০৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। নৌকার প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা পান ৩১ হাজার ৪৬৬ ভোট।
অনুষ্ঠানে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘কালাম (সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ) আর আয়েন (সাবেক সংসদ সদস্য) একটি কথা বলে গেছেন। এইবার আমরা যাঁরা নৌকার পক্ষে কাজ করেছি, কাঁচির লোকদের কাছে রাজাকারে পরিণত হয়েছি। যাঁরা আমাদের পথরুদ্ধ করতে চান, তাঁরা পারবেন না।’
আবদুল ওয়াদুদ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম সংসদ সদস্য হন। পরেরবারও তিনি দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। তবে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে আর প্রার্থী হননি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আবার তিনি দলীয় মনোনয়নে প্রার্থী হন। আবদুল ওয়াদুদ নৌকা প্রতীকে এবার ৮৬ হাজার ৯১৩ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ওবায়দুর রহমান ঈগল প্রতীকে পেয়েছেন ৮৩ হাজার ৮৬২ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এত বেশি ভোট পাওয়ায় আজকের সংবর্ধনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবদুল ওয়াদুদ।
প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘ফারুক ভাই বললেন, রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আজ মুক্ত হলো। কেন বললেন এ কথাটি, তার সারমর্ম রয়েছে। কী এমন রাজনৈতিক নেতা, আমার আসনে নৌকার বিরুদ্ধে এত ভোট পায়? তার রাজনৈতিক পরিচয় কী? একটাই কারণ, তার টাকা আর তার পেছনে রাজনৈতিক মহাশক্তি। পুঠিয়া-দুর্গাপুরে কে আছে এত যোগ্য? আমি নিজের কথা বলছি না। দুঃখে, কষ্টে, যন্ত্রণায় বলছি। আমার পুঠিয়া-দুর্গাপুরের বহু নেতাকে এই শহরের কিছু নেতা মুনাফেক বানিয়েছে, বেইমান বানিয়েছে, চরিত্র হনন করেছে।’
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আমাকে উদ্দেশ করে বলছে তা মনে হচ্ছে না। তবে ওপর থেকে থুতু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে তো। তাদের অভিরুচি অনুযায়ী তারা বলছে। তবে তারা সামান্যতম রাজনৈতিক সৌজন্য বা ভদ্রতা তারা রাখেনি, কার্ডে শহীদ কামারুজ্জামানের ছবিটাও ব্যবহার করেনি। টেলিফোনে বা চিঠি দিয়ে আমাকে উপস্থিত থাকতে বলেনি। এটা তারা কী করল, ভবিষ্যৎই তার উত্তর দেবে। মহানগর আওয়ামী লীগের মূল স্রোত তো আমরাই। ৯৫ শতাংশ তো আমাদেরই সঙ্গে। তাঁদের কাউকে না, ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কাউকে না, মহানগরে খণ্ডিত অংশ আর জেলার খণ্ডিত অংশ, এ নিয়ে তারা যদি আত্মতৃপ্তি পায়, সেটা তারা পেতেই পারে। তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। তাতে কোনো কিছু বিজয়ও হয় না।’
সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদকে সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী করার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সেই হিসেবে তিনি তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করবেন, সেটিই আশা করি। এটি দলাদলি করার জন্য নয়।’
‘বাঘ’ বলতে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কাকে বুঝিয়েছেন এবং ‘মুক্ত রাজশাহী’ মানে কী বুঝিয়েছেন, তা জানার জন্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে সভার পরে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘মুক্ত রাজশাহী মানে রাজশাহী “রাহুমুক্ত” হলো।’ রাহু কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা বুঝে নিতে হবে। বুঝে নিতে হবে কাঁচি মার্কার পক্ষে কে ছিল।’।