স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা শহর থেকে কিছুদিনের জন্য পরিবারসহ চলে যাচ্ছেন অনেকেই | ফাইল ছবি |
নিজস্ব প্রতিবেদক: পবিত্র ঈদুল ফিতরে এবার লম্বা ছুটি পাবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও লম্বা ছুটির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এবার বেশি মানুষ গ্রামমুখী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঈদযাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হচ্ছে আজ রোববার। বাড়ি যেতে টিকিট কাটতে হবে। আজ আন্তনগর ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে। বাসের টিকিট বিক্রি শুরুর দিনক্ষণ নির্দিষ্ট নেই। বাস কোম্পানিগুলো সূত্রে জানা গেছে, আগামী মঙ্গল ও বুধবার বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রিও পুরোদমে শুরু হবে।
পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামানের ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছাড়েন ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। সে হিসাবে ঈদের সময় প্রতিদিন গড়ে বাড়ি যান ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণপরিবহনব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বড়জোর দিনে ২২ লাখ লোক পরিবহন সম্ভব।
সব মিলিয়ে যথেষ্ট যানবাহনের অভাবে মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে। অন্যদিকে সড়কে দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নকাজের কারণে মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য সার্বিকভাবে সড়কের অবস্থা এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে ভালো।
ঈদে লম্বা ছুটি
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এবার ঈদের ছুটি থাকতে পারে ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল। পরদিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তার পরদিন রোববার আবার পয়লা বৈশাখের ছুটি। মানে হলো, সরকারি ছুটি পাঁচ দিন নিশ্চিত। পবিত্র শবে কদরের পর যদি কেউ দুই দিন ছুটি নিতে পারেন, তাহলে তিনি টানা ১০ দিন বাড়িতে কাটাতে পারবেন। কারণ, শবে কদরের আগের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি।
সাধারণত ছুটি বেশি হলে মানুষ বাড়িও যান বেশি। তবে ছুটি যতই থাকুক, ঈদের আগের দু-তিন দিন চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশেষ করে পোশাক কারখানা ছুটির পরই মূল চাপটা পড়ে। এ জন্য ২১ মার্চ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ঈদ প্রস্তুতি সভায় পোশাক ও শিল্পকারখানায় পর্যায়ক্রমে ছুটি দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রতিবছরই এই অনুরোধ করা হয়। তবে তা খুব একটা মানা হয় না।
ঈদে যত মানুষ ঢাকা ছাড়েন
ঈদে কত মানুষ ঢাকা ছাড়েন এবং গণপরিবহনের সক্ষমতা কী পরিমাণ—তার ওপর বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামানের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ঈদের আগের কয়েক দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষ বাস-মিনিবাসে, ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ ট্রেনে বসে ও দাঁড়িয়ে এবং সোয়া লাখ মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাড়ি যান সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রায় শামিল হন ৪ লাখ মানুষ।
সমীক্ষা বলছে, আরও ৮ লাখ মানুষ ট্রাক, অটোরিকশাসহ নানা অপ্রচলিত বাহনে ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করেন। এর বাইরে কিছু মানুষ উড়োজাহাজেও যাতায়াত করেন।
অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলেন, ঈদে সংকট দুটি—চাহিদার তুলনায় গণপরিবহন কম এবং যানজট। তিনি বলেন, ঈদের যাত্রীর চাপ যেহেতু স্বল্পস্থায়ী, তাই এর জন্য বাড়তি গণপরিবহন কিনে নামানো বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের যেসব যানবাহন আছে, সেগুলো যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করা যায়। রেলের সক্ষমতা বাড়ানো যায়।
অধ্যাপক হাদীউজ্জামান আরও বলেন, যানজট কমাতে অবকাঠামোগত সক্ষমতা বেড়েছে; কিন্তু ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া দরকার।
১৫৫ স্থানে ভোগান্তির শঙ্কা
৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে পবিত্র রমজান মাস ও ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ২১ মার্চ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও অংশীজনদের সঙ্গে ঈদ প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে ঈদে যানজট ও ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি হতে পারে—এমন ১৫৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়। এসব স্থানে ভোগান্তি এড়াতে সড়ক ও সেতু মেরামত এবং সেতুর টোল প্লাজা ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যানজটপ্রবণ যে ১৫৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রয়েছে ৪৮টি জায়গা। কাঁচপুর সেতুর আগে-পরে বেশ কিছু ইউটার্ন (গাড়ি ঘুরিয়ে আনার সুযোগ থাকে যেখানে) রাখা হয়েছে ওই তালিকায়।
ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের পথের মহাসড়কে রয়েছে ৫৫টি যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। এর মধ্যে বাইপাইল ও চন্দ্রা মোড় অন্যতম। ঢাকা-সিলেট পথে যানজটের ভোগান্তি হতে পারে এমন জায়গা রয়েছে ৪১টি। এই মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় চার লেনের কাজ চলছে। ফলে পূর্ণ গতিতে যানবাহন চলতে পারবে না। ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে ঝুঁকির জায়গা ৬টি। ঢাকা-আরিচা সড়কে ৮টি যানজটপ্রবণ জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে থাকা ১১টি সেতু এবং ২টি সড়কে টোল আদায় করা হয়। টোল আদায় কেন্দ্রে যানবাহনের চাপ পড়লে যানজট লেগে যায়।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে বড় কোনো বাধা চিহ্নিত করেনি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। তবে পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, এই পথে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও দোলাইরপাড় মোড় এখনই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য একটা ভোগান্তির জায়গা হয়ে উঠেছে। কারণ, সায়েদাবাদকেন্দ্রিক রাস্তায় যানজট থাকে। রাস্তার ওপর বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো হয়।
ঈদে সায়েদাবাদ হয়ে প্রতিবছর বরিশাল যান ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, দেখা যায় ছয় ঘণ্টায় বরিশাল যাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে দুই ঘণ্টাই লাগে সায়েদাবাদ ও দোলাইরপাড় পেরিয়ে মহাসড়কে যেতে।
ট্রেনের টিকিট অনলাইনে
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আজ প্রথম দিনে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আজ বিক্রি করা হবে আগামী ৪ এপ্রিলের টিকিট। সব টিকিট বিক্রি হবে অনলাইনে। টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইট ও অ্যাপের সার্ভারের (তথ্যভান্ডার) ওপর চাপ কমাতে টিকিট দেওয়া (ইস্যু) শুরু করা হবে দুই ধাপে। প্রথম ধাপে সকাল আটটা থেকে শুরু হবে পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগ) চলাচলরত ট্রেনের টিকিট বিক্রি। আর পূর্বাঞ্চলে (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ) চলাচল করা ট্রেনগুলোর টিকিট বিক্রি শুরু হবে বেলা দুইটা থেকে।
ঈদের অগ্রিম টিকিট শুধু আন্তনগর ট্রেনের জন্য প্রযোজ্য। ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে আসন রয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০টি। এর সঙ্গে প্রতিটি আন্তনগর ট্রেনের মোট আসনের ২৫ শতাংশ টিকিট বিক্রি করা হবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য (আসনবিহীন)। আসনবিহীন টিকিট যাত্রার আগে কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একজন যাত্রী অগ্রিম যাত্রা ও ফিরতি যাত্রার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একবার করে টিকিট কিনতে পারবেন। প্রতিবার সংগ্রহ করতে পারবেন সর্বোচ্চ চারটি টিকিট। অগ্রিম টিকিট ও ফিরতি অগ্রিম টিকিট ফেরত দেওয়া বা রিফান্ড করা যাবে না।
এবার প্রথমবারের মতো টিকিট ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতিতে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি ব্যবস্থা চালু করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই পদ্ধতি টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।
ঈদ উপলক্ষে এবার আট জোড়া বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঈদ ফিরতি অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে ৩ এপ্রিল।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির ফলে কালোবাজারির আশঙ্কা কমলেও দেশের একটা বড় অংশের মানুষ ট্রেনে যাতায়াত থেকে বঞ্চিত হবেন। কারণ, দেশের অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ। আন্তনগর ট্রেনে টিকিট কাটতে হলে ইন্টারনেট সুবিধা ও স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটার থাকতে হবে।
রেলওয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা জানেন যে অনেক মানুষ টিকিট কাটার সুযোগ পাবেন না। কিন্তু সবাইকে দেওয়ার মতো টিকিটও নেই। তাই কালোবাজারি প্রতিরোধে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।