নিজস্ব প্রতিবেদক: ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ইউরোপ থেকে ছয়টি ছাদখোলা দ্বিতল বাস (ট্যুরিস্ট কোচ) কেনা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এসব বাস কিনতে দুবার দরপত্র ডাকা হলেও কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাতে সাড়া দেয়নি। তৃতীয়বারের মতো শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে পর্যটন করপোরেশন। তবে এবারও কারও দরপত্রে অংশ না নেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
ট্যুরিস্ট বাস আমদানিকারকেরা বলছেন, পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তাদের খামখেয়ালি, পরিকল্পনায় ঘাটতি ও অদূরদর্শিতার কারণে ইউরোপ থেকে বাস কেনার প্রক্রিয়া ভেস্তে যাচ্ছে। দরপত্রে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা মেনে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাস আনা সম্ভব নয়। এ কারণে দরপত্রে কেউ অংশ নিচ্ছে না।
পর্যটন করপোরেশন সূত্র বলছে, আগামী জুনের মধ্যে ট্যুরিস্ট বাসগুলো আনতে হবে। তা না হলে আবার প্রকল্প সংশোধন করতে হবে। সূত্রমতে, সে ক্ষেত্রে প্রকল্পটি বাতিলও হয়ে যেতে পারে।
পর্যটকদের দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাতে ইউরোপ থেকে এসব বাস কেনার সিদ্ধান্ত হয় ২০২০ সালে। একই বছর ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় ট্যুর পরিচালনার লক্ষ্যে ট্যুরিস্ট কোচ সংগ্রহ’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
তিন বছর পেরিয়ে গেলেও মাত্র ছয়টি ট্যুরিস্ট বাস কেন কেনা গেল না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এর তিনটি কারণ জানা গেছে। এক. দরপত্রে বলা হয়েছে, ট্যুরিস্ট বাসগুলো হবে ছাদখোলা, আবার তাতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রও (এসি) থাকতে হবে। দুই. বাসগুলো আমদানির পর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ পর্যটন করপোরেশন দেবে, নাকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেবে, তার উল্লেখ নেই। এবং তিন. ডলার–সংকট ও এলসি (ঋণপত্র) খোলার জটিলতা। এসব কারণে কেউ দরপত্রে অংশ নিচ্ছে না।
সূত্র বলছে, গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পর্যটন করপোরেশনের সম্মেলনকক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। ওই সভায় প্রকল্পের মধ্যে নতুন করে ১৫ শতাংশ ‘স্পেয়ার পার্টস’ খরচ ধরার আলোচনা হয়, যাতে বাস আমদানির পর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ সেখান থেকে দেওয়া যায়। এটি করতে গেলে প্রকল্পের খরচ বাড়বে। প্রকল্পের খরচ না বাড়িয়ে ছয়টির পরিবর্তে পাঁচটি বাস আমদানির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
পর্যটন করপোরেশন বলছে, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির পর বাস আমদানিতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগে। তাই আগামী জুনের মধ্যে ট্যুরিস্ট বাস আমদানি অনেকটাই অনিশ্চয়তায় পড়ল।
পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত
একটি সূত্র জানায়, ট্যুরিস্ট বাস কেনার ব্যাপারে কারও মতামত নেয়নি পর্যটন করপোরেশন। নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়া ছিল ভুলে ভরা। যেমন পরিকল্পনায় ছিল, ট্যুরিস্ট বাসগুলো হবে ছাদখোলা, কিন্তু এসিও থাকবে। টয়লেট-সুবিধা রাখা হলেও খাবার গরম করার জন্য প্যান্ট্রি-সুবিধা রাখা হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য হুইলচেয়ারের মাধ্যমে বাসে ওঠার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বাসগুলো কোথায় রাখা হবে, সে পরিকল্পনাও করা হয়নি।
সূত্রমতে, প্রকল্প অনুমোদনের পরের বছর ২০২১ সালে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এসব অসংগতি ধরা পড়ে। তখন প্রকল্পটি সংশোধন করে বৃষ্টি ও গরমের সময় যাতে ছাদ বন্ধ করা যায়, আবার খোলা যায়, সে ব্যবস্থা রেখে কাস্টমাইজড বাস আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। বাসের পরিবেশ ঠিক রাখতে টয়লেট-সুবিধা বাদ দেওয়া হয়। যুক্ত করা হয় প্যান্ট্রি-সুবিধা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজে যাতায়াতের জন্য হুইলচেয়ারের মাধ্যমে বাসে ওঠার ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়। এসব বাস রাখার জন্য শেড নির্মাণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। তখন প্রকল্পের ব্যয় ৮ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ কোটিতে। প্রথমে প্রতিটি বাসের দাম ধরা হয় সোয়া তিন কোটি টাকা। সংশোধন করার পর তা দাঁড়ায় সোয়া চার কোটি টাকায়।
প্রকল্প পরিচালক এহসান কবীর বলেন, তৃতীয়বার যদি কোনো ঠিকাদার দরপত্রে অংশ না নেন, তখন পুরো বাজার যাচাই করা হবে। কেন কোনো ঠিকাদারেরা আসছেন না, কোন জায়গায় সমস্যা, তা দেখা হবে। ট্যুরিস্ট বাসের দামে সমস্যা নাকি দরপত্রের শর্তে সমস্যা, তা পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দরপত্রের শর্ত শিথিলের পরামর্শ
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ইউরোপ থেকে বাস কিনতে গত বছরের ৩০ এপ্রিল প্রথম দরপত্র আহ্বান করে পর্যটন করপোরেশন। কিন্তু একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও তাতে অংশ নেয়নি। একই বছর ৭ নভেম্বর আবার দরপত্র ডাকা হয়। এতেও কেউ সাড়া দেয়নি। পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বাজারে ডলারের সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। এ কারণে দরপত্র প্রস্তাব জমা পড়ছে না।
তবে র্যাংগস পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের সাবেক হেড অব সেলস মুশফিক সালেহীন বলেন, ইউরোপ থেকে বাস কিনতে দরপত্রে যা চাওয়া হয়, তা কেউ পূরণ করতে পারবে না। কারণ, তাঁরা একদিকে বলছে ট্যুরিস্ট কোচ হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, আবার বলা হচ্ছে ছাদখোলা। এ শর্ত মেনে বাস আমদানি করা সম্ভব নয়।
বেসরকারি উদ্যোগে ২০২১ সালে কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো একটি ছাদখোলা বাস চালু হয়। ৪৮ আসনের দ্বিতল বাসটি কক্সবাজারের কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে টেকনাফ পর্যন্ত চলাচল করছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক অমূল্য কুমার দেবনাথ বলেন, সাধারণত দুবার দরপত্র ডাকার পর কাউকে পাওয়া না গেলে তখন ওই খাতের ঠিকাদারদের ডেকে জানতে চাওয়া যেত, সমস্যা কোথায়? দরপত্রে এমন কোনো শর্ত আছে কি না, যে কারণে কেউ দরপত্রে অংশ নিচ্ছেন না। তখন দরপত্র সংশোধন করা যেত। এখনো সময় আছে, চাইলে পর্যটন করপোরেশন দরপত্রের শর্ত শিথিল করতে পারে।