দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন | প্রতীকী ছবি

প্রতিনিধি নাটোর: ভোটের দিন ঘনিয়ে আসতেই শীতটা জেঁকে বসেছে। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নাটোর শহরে পা রাখতেই শীতের তীব্রতা ভালোই টের পাওয়া গেল। তাৎক্ষণিকভাবে সড়কের ওপর পোস্টার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আমেজ সেভাবে মিলল না। দু–একটা নির্বাচনী ক্যাম্প চোখে পড়ল, তা–ও শূন্য। কৌতূহল নিয়ে কানাইখালীর দু-তিনটি চায়ের দোকানে ঢুঁ দিলাম। সেখানকার পরিবেশও শীতল। স্থানীয় লোকজন কেউ কেউ বললেন, শীতে জবুথবু শহর, একটু তাড়াতাড়ি ঘুমায়।

অবশ্য নাটোর-২ আসনের (সদর ও নলডাঙ্গা) নির্বাচন একেবারে নিরুত্তাপহীন নয়। এই আসনে নৌকা পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। তবে আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করছেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. আহাদ আলী সরকার। এই দুজনই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে আছেন। এই দুই প্রার্থীকে কেন্দ্র করে জেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও বিভক্ত। একটা অংশ আহাদ আলী সরকারের পক্ষে মাঠে নেমেছে। আরেকটি পক্ষ নৌকার হয়ে কাজ করছে।

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম নৌকার পক্ষে প্রচার–প্রচারণায় অংশ নিলেও সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী আহাদ আলী সরকারের পক্ষে কাজ করছেন।

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা দুই ভাগ হয়ে নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামার কারণে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটি দেখার একধরনের কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সারা দিন নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার সাধারণ ভোটার, নাগরিক সমাজ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেল। তাঁরা বলছেন, টানা দুই মেয়াদের পর বর্তমান সংসদ সদস্য শক্ত পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছেন।

এদিকে আহাদ আলী সরকার প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগে এখন পর্যন্ত নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ২৫টি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য চাপ, পোস্টার ছেঁড়া, এজেন্টদের হুমকি ইত্যাদি। যদিও গত রোববার নৌকার একটি ক্যাম্প পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়ার বিষয়ে নৌকার প্রার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। তারা অপকর্ম করে দায়ভার আমাদের ওপর চাপাচ্ছে।’
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক আবু নাসের ভূঁঞা প্রথম আলোকে বলেন, আহাদ আলী সরকারের সবগুলো অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে। কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। যেগুলোর সত্যতা মিলেছে, সেগুলোর বিষয়ে জিডি ও মামলা করা হয়েছে।

এই আসনে মোট প্রার্থী পাঁচজন। অন্যরা হলেন জাতীয় পার্টির মো. নূরন্নবী মৃধা (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোহাম্মদ বজলুর রশিদ (ডাব), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মো. শরিফুল ইসলাম (মশাল)। তাঁদের মধ্যে শুধু লাঙ্গলের কিছু পোস্টার নলডাঙ্গার বাসুদেবপুরে দেখা গেল। বাকিরা সেভাবে প্রচার–প্রচারণায় নেই।
নাটোর-২ আসনে মোট ভোটারসংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫০। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৮ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৫৭ জন।

আওয়ামী লীগ কেন বিভক্ত
২০১৪ সালে নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন শফিকুল ইসলাম। ওই বছরই তিনি দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি পদ পাওয়ার পর স্ত্রী, বড় ভাই ও ভাবি, বোনসহ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে বসান। বিভিন্ন লাভজনক খাতও সংসদ সদস্য ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে শফিকুল ইসলাম সংসদ সদস্য হন। ২০২১ সালে নাটোরের সরকারদলীয় চার সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের চারজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে সংসদ সদস্য শফিকুলের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দলকে পারিবারিকীকরণের বিষয়ে অভিযোগ করেন। তারপর ২০২২ সালের শুরুতে তাঁকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে গত বছর সহসভাপতির পদ পেয়েছেন।

যদিও শফিকুল ইসলামের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। কিন্তু মূলত এসব বিষয় নিয়েই সেখানকার আওয়ামী লীগ বিভক্ত। এবার ভোটে সেই বিভক্তি বেড়েছে। পুরোনো নেতা আহাদ আলী সরকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তাঁর সমর্থনে ভোটের মাঠে দলের বড় অংশ।

বিএনপির কর্মীরা ফিরছেন
গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে ছিলেন। এখন আত্মগোপনে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।

উপজেলা পর্যায়ের বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্বাসে বাড়ি ফিরেছি। নৌকা প্রতীকের লোকজন ভোট দিতে যেতে চাপ দিচ্ছে। তবে কোনো কারণে নির্বাচনের ফল ব্যতিক্রম কিছু হলে হামলার শঙ্কায় আমরা যেতে চাই না।’

বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে আনার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, এটি তো দোষের কিছু না। তাঁদের নেতারা হয়তো আসবেন না। তবে কর্মীরা ভোট দেবেন।