নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা অভিযোগ ও অসন্তোষে বুধবার সিলেট এবং চুয়াডাঙ্গার জাতীয় পার্টির তিনজন প্রার্থী নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে ভোটের প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। একে একে প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দলটির জন্য ‘অশনিসংকেত’ কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলে।
শীর্ষ নেতাদের অসহযোগিতা, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয়, ভোটের মাঠে হুমকি ও চাপের কথা জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীরা। এর বাইরে এবার জাপার আরও ১১ জন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেয়েও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। সব মিলে দলটির ২৬ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন ও প্রত্যাহার করলেন।
গতকাল চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সোহরাব হোসেন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের রবিউল ইসলাম ও সিলেট-৫ আসনের প্রার্থী সাব্বির আহমদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
সাব্বির আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, সরকার এবং নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী মাঠে সে রকম পরিবেশ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচন করা খুবই কঠিন। তিনি বলেন, গত ৩০ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে কিছু অভিযোগ দেন। অভিযোগ দেওয়ার পর আরও ব্যাপকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপার প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চলতে পারে। তাঁরা মনে করছেন, ভোটের মাঠে নানা ধরনের প্রতিকূলতায় পড়ে জাপার প্রার্থী অনেকে হতাশায় পড়েছেন। এর মধ্যে নির্বাচনী তহবিল না পাওয়া অন্যতম। প্রার্থীরা আশায় ছিলেন, তাঁরা সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাবেন। সেটি না পেয়ে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারে নেমে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না। উল্টো নানা ধরনের চাপ, অনেক জায়গায় হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই হুমকি বা চাপ কেবল নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কাছ থেকে যে তা নয়, দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছ থেকেও আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এবার আওয়ামী লীগ নির্বাচনী সমঝোতায় জাপাকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়। এই আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে কোনো প্রার্থী রাখেনি। যদিও এই ২৬টি আসনের কয়েকটি বাদে অধিকাংশ আসনেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। ফলে সমঝোতার আসনগুলোতেও তাঁরা ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না। উল্টো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
রাজধানী ঢাকা-১৮ আসনটি সমঝোতায় জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবীব হাসান তাঁর পক্ষে কাজ করছেন না। তিনি তাঁর দলের এক স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এস তোফাজ্জল হোসেনের জন্য কাজ করছেন বলে জানান শেরীফা কাদের।
একইভাবে জাপার সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে পটুয়াখালী-১ আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। সেখানে তাদের প্রার্থী ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন। রুহুল আমিন হাওলাদার জানান, আফজাল হোসেন নেপথ্যে থেকে বাংলাদেশ কংগ্রেসের ‘ডাব’ প্রতীকের প্রার্থী নাসির উদ্দিন তালুকদারের জন্য কাজ করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ভোটের মাঠে এমন বৈরিতার মুখে পড়ে অনেক জায়গায় জাপার প্রার্থীরা হতাশ হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছেন। সুনামগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী আবদুল মান্নান তালুকদার কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, এটা আসন ভাগাভাগি ও প্রহসনের নির্বাচন।’
গতকাল তিনজনসহ এ পর্যন্ত ১৫ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা হলেন দিনাজপুর-২ আসনের মাহবুবুল আলম, নওগাঁ-২ আসনের মো. তোফাজ্জল হোসেন, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের জাকির হোসেন, বরগুনা-১ আসনের মো. খলিলুর রহমান, বরিশাল-২ ও ৫ আসনের ইকবাল হোসেন, টাঙ্গাইল-৭ আসনের জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর-১ ও ৫ আসনের এম এম নিয়াজ উদ্দিন, গাজীপুর-২ আসনের জয়নাল আবেদীন, গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) সামসুদ্দিন খান, হবিগঞ্জ-২ আসনের শংকর পাল, কুমিল্লা-২ আসনের এ টি এম মঞ্জুরুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ-১ আসনের আবদুল মান্নান তালুকদার। এর মধ্যে বরিশাল ও গাজীপুরে দুজন প্রার্থী চারটি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন।
গাজীপুর-৪ আসনের জাপার প্রার্থী সামসুদ্দিন খান ‘চাপ ও হুমকির’ কথা জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছেন। তিনি মঙ্গলবার কাপাসিয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা ঘোলাটে। বিভিন্ন চাপ ও হুমকি আছে আমার ওপর।’
গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের প্রার্থী সোহরাব হোসেন জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ২৮৩ জন। এর মধ্যে ২৬ জনের জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে বাকি ২৫৭ জনকে অসম্মান করা হয়েছে।
সোহরাব হোসেন বলেন, ‘১৮ ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের আচরণে আমরা হতাশ। চেয়ারম্যান (জি এম কাদের) ও মহাসচিব (মুজিবুল হক) যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। যেহেতু তাঁরা মাত্র ২৬ জন প্রার্থীকে নিয়ে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন, বাকি ২৫৭ জনকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর্থিকভাবে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
জাপার দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এবারের নির্বাচন দলের জন্য, বিশেষ করে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের জন্য শেষ পর্যন্ত সুখকর না-ও হতে পারে। অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা সঠিকভাবে হয়নি। আসন সমঝোতায় ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতার বাদ পড়া অবিশ্বাস ও ক্ষতের সৃষ্টি করবে।
এ ছাড়া সারা বছর এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে, শেষ মুহূর্তে ভোটে যাওয়া সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এতে দলের প্রতি মানুষের আরও আস্থা কমবে। এখন প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে জাপার প্রার্থীদের ভোট প্রাপ্তির হার কমে যেতে পারে।
বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য জাপার চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের নীতিনির্ধারণী একজন নেতা বলেন, ‘সবাই জানে নির্বাচন ছাড়া জাতীয় পার্টির কোনো উপায় নেই। আর আওয়ামী লীগই আমাদের ভরসা। তাহলে আমরা নির্বাচন নিয়ে এত কথা বললাম কেন। বললাম তো নির্বাচনে গেলাম কেন। আর যাব তো সমঝোতার জন্য উচ্চপর্যায়ের টিম না করে কেবল দুজনকে (মুজিবুল হক ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ) দায়িত্ব দিলাম কেন। আমি জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকারই দেখি।’