রাগেবুল আহসান, আবদুল মান্নান ও সৈয়দ কবির আহমেদ | ছবি: সংগৃহীত

প্রতিনিধি বগুড়া: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৬ (সদর) আসনে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। একটি অংশ দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান ওরফে রিপুর সঙ্গে থাকলেও প্রভাবশালী কয়েকটি পক্ষ কাজ করছে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। এতে শেষ মুহূর্তে অস্বস্তিতে পড়েছেন নৌকার কর্মী-সমর্থকেরা।

ভোটার ও দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া–৬ আসন। এবার বিএনপি নির্বাচনে না আসায় নৌকার জয়ের ব্যাপারে অনেকটা ‘নির্ভার’ ছিল আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের একটি অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দকে (ট্রাক) সমর্থন দিচ্ছেন। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহমেদের (ঈগল) পক্ষেও কিছু নেতা কাজ করছেন।

২০২১ সালের বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ায় আবদুল মান্নানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ওই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি ভোট পেয়ে আলোচনায় আসেন। যদিও নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপির প্রার্থী। এরপর গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া–৬ আসনে বিএনপিবিহীন উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী রাগেবুলের বিরুদ্ধে লড়ে হেরে যান মান্নান। এবারের নির্বাচনেও তিনিই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করছেন ভোটাররা।

স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ সদস্য থাকাকালে রাগেবুল আহসানের সঙ্গে দলের অনেক কর্মী-সমর্থকের দূরত্ব তৈরি হয়। কিছু নেতা-কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা রয়েছেন। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুই দশকের বেশি সময় ধরে একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন মঞ্জুরুল আলম ওরফে মোহন। বিশেষ করে ছাত্রলীগের একাংশ এবং যুবলীগের নেতৃত্ব চলে আসছে তাঁর নির্দেশনায়। মঞ্জুরুল আলম এখন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা নিয়ে সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের সঙ্গে মঞ্জুরুল আলমের দ্বন্দ্ব হয়। এ ছাড়া নানা বিষয় নিয়ে রাগেবুল আহসানের সঙ্গে শহর যুবলীগের সাবেক নেতা ও বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর আবদুল মতিন, সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক নেতা এবং বাসমালিকদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামসহ বেশ কিছু নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। রাগেবুল ইসলাম এবারের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেলেও নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচেনি। ফলে নির্বাচনে তাঁর বিরোধীরা অনেকটা প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নানের পক্ষে সরব হয়েছেন।

এদিকে আবদুল মতিন ও আমিনুল ইসলামের সঙ্গে দূরত্ব ছিল মঞ্জুরুল আলমেরও। কয়েক দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নানের উদ্যোগে মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাউন্সিলর আবদুল মতিন ও আমিনুল ইসলাম। সেখানে অন্যদের মধ্যে জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলালও উপস্থিত ছিলেন। মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে আলোচিত এ বৈঠকের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মঞ্জুরুল আলম নৌকার প্রার্থী রাগেবুল আহসানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব পদেও আছেন।

জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনে নৌকার পক্ষে এক হয়ে কাজ করেছিলেন। কিন্তু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর রাগেবুল আহসান কথা রাখেননি। তাঁর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নানের ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন। আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাক জেতাতে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। সব দ্বন্দ্ব ভুলে আমরা একসঙ্গে থাকব বলে ওয়াদা করেছি। তিনি যেহেতু জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন, সে কারণে প্রকাশ্য হয়তো নৌকার বিপক্ষে কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু আবদুল মান্নানও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা। মঞ্জুরুল আলম প্রকাশ্যে ট্রাকের পক্ষে কাজ না করলেও তাঁর সমর্থকেরা এখন ট্রাকের পক্ষে কাজ করছেন।’
এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম ফোন ধরেননি।

এমন অবস্থায় রাগেবুল নৌকার প্রচারণায় জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পাশে পাচ্ছেন না। জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান বলেন, কিছুটা সমন্বয়হীনভাবে নৌকার প্রচারণা চলছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন নিজেদের মতো করে নৌকার প্রচার–প্রচারণা চালাচ্ছে। মঞ্জুরুল আলমের বিষয়ে এই নেতা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে ওই বৈঠক নির্বাচনী কোনো সভা ছিল না বলে মঞ্জুরুল আলম জানিয়েছেন। ওই বৈঠক ছিল কার্যত পরিবহন ব্যবসা নিয়ে। এরপরও নির্বাচন সামনে রেখে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করায় ভোটারদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। মঞ্জুরুল আলম এখন পর্যন্ত সেই বিভ্রান্তি নিরসনে দলীয় সভায় স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেননি।

নেতা-কর্মীরা বলেন, মঞ্জুরুল আলম সরাসরি রাগেবুল আহসানের বিরোধিতা না করলেও নৌকার পক্ষে কোথাও কোনো সভা–সমাবেশে এখন পর্যন্ত তাঁকে ভোট চাইতে দেখা যায়নি। তবে দলীয় কার্যালয়ে এসে তিনি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির হয়ে কিছু কার্যক্রম সমন্বয় করছেন।

গত রোববার নির্বাচনী এলাকা ঘুরে অন্তত ২৫ জন ভোটারের সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়। ভোটাররা বলেন, বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে আওয়ামী লীগের ৭০ থেকে ৮০ হাজার ভোট আছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় অনেক ভোটার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে কেন্দ্রেও যাবেন না। এখন ভোটার কেন্দ্রে টানতে নৌকা ও ট্রাকের প্রার্থীর পক্ষের কর্মীরা মাঠে সরব। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ কবির আহমেদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সৈয়দ সার্জিল আহমেদসহ আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী।
সৈয়দ কবির আহমেদ বলেন, ‘ঈগলের পক্ষে ভোটের জোয়ার উঠেছে। সুষ্ঠু ভোট হলে আমিই বিজয়ী হব।’

স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নান বলেন, ‘সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর রাগেবুল শুধু আখের গুছিয়েছেন। এলাকার উন্নয়নে কোনো ভূমিকা নেননি। জনগণের কোনো খোঁজও নেননি। জনগণের সুখ–দুঃখে সব সময় নানা সহায়তা নিয়ে পাশে ছিলাম। উপনির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত হলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত।’

জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী রাগেবুল আহসান বলেন, নৌকা জেতাতে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এককাট্টা। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিভেদ নেই। সবাই একযোগে কাজ করছেন। মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বৈঠক দোষের কিছু নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি নেই। মঞ্জুরুল আলম নিজেও নৌকার নির্বাচনী কৌশল সমন্বয় করছেন। তবে সভা–সমাবেশে তিনি এখনো বক্তব্য দেননি।

রাগেবুল আহসান, আবদুল মান্নান এবং সৈয়দ কবির আহমেদ ছাড়াও এখানে জাকের পার্টির ফয়সাল বিন শফিক, জাপার আজিজ আহম্মেদ এবং এনপিপির শহিদুল ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।