প্রতিনিধি নাটোর: পথসভা ও গণসংযোগে ভোটারদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ। একই সঙ্গে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবেন, এমন আশ্বাস দিচ্ছেন তিনি। ফেসবুকে এ রকম বেশ কিছু ভিডিও দেখতে দেখতে কুয়াশায় মোড়ানো সকালে পৌঁছে গেলাম নাটোরের সিংড়া উপজেলা সদরে।
এই এলাকার (নাটোর–৩ আসন) সংসদ সদস্য জুনাইদ আহ্মেদ। তিনি টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্যের পাশাপাশি ১০ বছর ধরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে সিংড়ায় পৌঁছেই খবর পাওয়া গেল, নৌকার কর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলামের (ঈগল) এক কর্মীকে মারধর করেছেন। আরেক কর্মীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। আরও জানা গেল, দুটি ঘটনা ঘটেছে গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে, সিংড়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে চৌগ্রাম ইউনিয়নের সারদানগর ও তেরবাড়িয়া গ্রামে। যে কর্মীকে মারধর করা হয়েছে, তাঁর নাম সোহাগ হাসান।
উপজেলা সদর থেকে সারদানগর গ্রামে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেল। সেখানে কথা হয় গ্রামের ১০-১২ জন বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁদের কথা, এ রকম কিছু ঘটবে, সেটি তাঁদের ভাবনাতেও ছিল না।
সিংড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে নাটোর-৩ সংসদীয় আসন। স্থানীয়ভাবে আলোচনা আছে, ৭ জানুয়ারির ভোটে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জুনাইদ আহ্মেদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলামের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। শফিকুল সিংড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি সিংড়া পৌর আওয়ামী লীগেরও সাবেক সভাপতি। দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন, না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদবঞ্চিত নেতারা ভোটের প্রচারে তাঁর সঙ্গে আছেন।
এই আসনে মোট প্রার্থী নয়জন। জুনাইদ ও শফিকুল ছাড়া অন্য প্রার্থীরা হলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির মিজানুর রহমান (হাতুড়ি), জাতীয় পার্টির মো. আনিসুর রহমান (লাঙ্গল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের আনোয়ার হোসেন (কুলা), তৃণমূল বিএনপির আবুল কালাম আজাদ (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ কংগ্রেসের আমিনুল ইসলাম (ডাব), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের আলতাফ হোসেন (ফুলের মালা) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন (ট্রাক)।
এলাকাছাড়া করার হুমকি
সিংড়া উপজেলা সদর থেকে সারদানগর গ্রামে ঢোকার আগেই শ্মশানঘাটের সামনে পাওয়া যায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী মো. সোহাগ হাসানকে। তখন তিনি একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে গ্রাম ছেড়ে উপজেলা সদরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সঙ্গে তাঁর মা, স্ত্রী ও ১৩ মাস বয়সী সন্তান ছিলেন।
সোহাগ জানান, গত মঙ্গলবার গভীর রাতে নৌকার ২০-২৫ জন কর্মী তাঁদের বাড়িতে আসে। দরজা ভেঙে ঘর থেকে বের করে তাঁকে মারধর করেছে। পরে তাঁকে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেছে। ভোট শেষ হওয়ার আগে গ্রামে ফিরলে বিপদ হবে বলে হুমকি দিয়েছে। মারধরে তাঁর পা ফুলে গেছে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লেগেছে।
পরে সোহাগের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর বাবা ইদ্রিস সরদারের সঙ্গে। তিনি বললেন, মঙ্গলবার রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে নৌকার বেশ কিছু কর্মী তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায়। দরজা ভেঙে সোহাগকে ঘর থেকে বের কর আনে তারা।
সোহাগের চাচাতো বোন নূরজাহান বেগম বললেন, সোহাগকে পাশের ঘরের উঠানে ফেলে লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়েছে নৌকার কর্মীরা। সোহাগকে বাঁচাতে তাঁর স্ত্রী ঋতু বেগম এগিয়ে এলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় ঋতুর কোল থেকে বাচ্চা পড়ে যায়। ভাগ্যক্রমে শিশুটির বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।
সোহাগের বাড়ির উঠানে তাঁর বাবা–বোনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন গ্রামের ১০–১২ জন সেখানে জড়ো হন। তাঁরা বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সারদানগর গ্রামে প্রচার চালাতে এসেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। ওই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সোহাগ।
স্থানীয় কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ভোট নিয়ে কখনোই সারদানগর গ্রামে এমন হামলার ঘটনা ঘটেনি। এই ঘটনায় একটা আতঙ্ক কাজ করছে। ভোট দিতে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে ভোট দিতে যাব।’
সারদানগর থেকে তেরবাড়িয়া গ্রামে ঈগলের প্রার্থীর আরেক কর্মী সাজ্জাদ প্রামাণিকের বাড়িতেও যান প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক। নৌকার কর্মীরা মঙ্গলবার রাতে এই বাড়িতে এসেছিলেন সাজ্জাদ ও তাঁর ছেলেকে খুঁজতে। সাজ্জাদের ছোট ছেলে সাব্বির আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ১৫-২০ জন নৌকার কর্মী হঠাৎ বাড়ির ভেতর ঢুকে বাবা ও বড় ভাই শামীম হোসেনকে খুঁজতে থাকে। তাঁদের না পেয়ে হুমকি–ধমকি দিয়ে চলে যায়। তারপর থেকে ভয়ে বাবা ও ভাই এলাকাছাড়া।
নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে কর্মীদের এলাকাছাড়া করতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, মঙ্গলবার রাতে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ১০টি জায়গায় তাঁর কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। দুজন আহত হয়েছেন। কয়েকজন এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এসব ঘটনা বন্ধে বিভিন্ন সংস্থা যদি গুরুত্বসহকারে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুবই নেতিবাচক ধারণা হবে।
অবশ্য হামলার বিষয়টি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ জানেন না বলে জানান। তবে তিনি বলেন, এমন কিছু ঘটলে তা খুবই খারাপ হয়েছে।
ক্ষমা চাওয়ার কারণ
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদের নিজের ইউনিয়ন শেরকোল। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবিব। এই ইউনিয়নকে দুই ভাগ করেছে খালের মতো ছোট্ট একটি নদ, নাম বারনই। এই নদের ওপর সেতু করা হয়েছে। তবে সেতুর সংযোগ সড়ক নেই। সেতুর এক পাশে বন্দর নামে হাট রয়েছে।
গতকাল বিকেলে বন্দর হাটে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী মুজিবর রহমান, সুরুজাল মিয়াসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, ছোট্ট সেতুটি ব্যবহার করতে না পারায় ইউনিয়নের এক পাশের লোকজনকে ৩-৪ কিলোমিটার ঘুরে হাটে আসতে হয়। প্রতিমন্ত্রী ও চেয়ারম্যানকে বহুবার বলেও সুরাহা হয়নি।
সিংড়ার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় ২০ জনের সঙ্গে গতকাল কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, উপজেলাটির ১২টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়র প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন। ৪-৫ জন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সরকারি জলাশয় দখল করে রেখেছেন। তাতে স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীরা সংকটে পড়েছেন। আবার সালিসের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেন তৃণমূলের কয়েকজন প্রতিনিধি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে গতকাল দুপুরে সিংড়ায় নিজের বাসভবনে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। পথসভায় ভোটারদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু জায়গায় মানুষ অসম্মানিত, প্রতারিত ও নির্যাতিত হয়েছে। এসব ঘটনায় কয়েকজন জনপ্রতিনিধির নাম এসেছে। তবে আমার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলেই বিশ্বাস করি। তারপরও আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি নিজে যখন ক্ষমা চাচ্ছি, তখন ভোটাররা বলছেন, তুমি তো অপরাধ করো নাই। তবে এই দায় আমার এড়ানোর সুযোগ নেই। তার খেসারত আমাকে দিতে হচ্ছে।’