চলতি শীতে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা সম্প্রসারিত ভবনের সামনের জলাশয়ে এই পাখিগুলো এসেছিল। পরে চলে গেছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। সূর্যের উঁকি, সঙ্গে পাখির কিচিরমিচির। কুয়াশাচ্ছন্ন জলাশয়ে চোখ মেললেই লাল শাপলার বুকে পাখির জলকেলি। দিগন্তজুড়ে তাদের বিচরণ। শীতে এমন চেনা দৃশ্যই ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলো ছিল পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম, যা এখন বিলুপ্তির পথে। নানা অব্যবস্থাপনায় পরিযায়ী পাখির জলকেলি কিংবা ওড়াউড়ির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন সহসা দেখা মেলে না।
বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণ, সময়মতো জলাশয় সংস্কার না করা, লেকের পাড়ে জনসমাগম এবং কোলাহল ক্যাম্পাসকে পাখির বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে। সাধারণত প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসা শুরু করে ক্যাম্পাসে। তবে বিগত দুই বছরে এ চিত্র ভিন্ন। জানুয়ারি মাসেও জলাশয়গুলোতে পাখির দেখা নেই। নেই আগের মতো পাখিদের কিচিরমিচির।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি শীতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরের পাশের জলাশয়, স্কুল অ্যান্ড কলেজের খেলার মাঠের পূর্ব পাশের জলাশয়, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারসংলগ্ন জলাশয়, নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয় এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনসংলগ্ন জলাশয়ে অতিথি পাখিতে পূর্ণ থাকত। দেশি–বিদেশি মিলিয়ে দুই শতাধিক প্রজাতির পাখি দেখা যেত। কিন্তু গত দুই বছরে পাখি আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারসংলগ্ন জলাশয় ছাড়া কোনো জলাশয়ে পাখির দেখা নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহণ চত্বর লেক | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১টি স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১০ তলাবিশিষ্ট ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণকাজ শেষ। এর বাইরে একাডেমিক ভবনের সম্প্রসারণ, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন ও খেলার কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ চলমান। প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল। সমীক্ষায় পাওয়া ফলাফল ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে পাখিদের অবাধ চলাচল নিশ্চিতে ২০ মিটার বা ছয়তলার বেশি উঁচু ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক থেকে ন্যূনতম ১০০ মিটার দূরত্বে নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এসব সুপারিশ মানা হয়নি। বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যে হারে পাখি আসত, এখন সে হারে পাখিরা আসতে পারছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, বহুতল ভবন থাকলে পাখির ‘ফ্লাইট জোন’ নষ্ট হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক পাখি আসার বিষয়টি ইতিহাস হতে চলেছে বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলোতে ওই অর্থে পাখি একেবারেই নেই। কারণ, হলসহ বিভিন্ন জায়গার পয়োবর্জ্য জলাশয়ের পানিতে মিশে পানির গুণগত মান নষ্ট হয়েছে। লেকগুলো অপরিষ্কার এবং দর্শনার্থীদের উৎপাতে ব্যাপক শব্দদূষণ হয়ে থাকে। ক্যাম্পাসে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণও পাখি না আসার কারণ। পাখি তো হেলিকপ্টার না। তাদের ওঠা-নামার জন্য একটা ফ্লাইট জোন থাকে, যেটা সংকুচিত হয়েছে এসব স্থাপনার জন্য।
নেই উদ্যোগ
কয়েক বছর আগেও অতিথি পাখির আগমনের আগে আগে জলাশয়গুলো পরিষ্কার করা হতো। এ বছর কয়েকটি জলাশয় পরিষ্কার করা হলেও বেশির ভাগ জলাশয় পরিষ্কার করা হয়নি। যার কারণে নভেম্বরের শেষ দিকে চারুকলা সম্প্রসারিত ভবনের পাশের জলাশয়ে অর্ধশতাধিক পাখি এলেও কিছুদিন পর চলে যায়। অন্য বছরের পাখি আগমনের এই সময়ে লেকগুলোর চারপাশে কাঁটাতারের মজবুত বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা হতো। গাছে গাছে টাঙানো থাকত পাখিবিষয়ক সচেতনতার বিভিন্ন পোস্টার। এবার সেসবের কিছুই নেই।
পাখিবিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, অতিথি পাখি না আসার প্রধান কারণ হলো জলাশয়পাড়ের প্রতিকূল পরিবেশ, যা পাখিদের জন্য বিরক্তিকর। লেকগুলোর পাড়ে ব্যাপক মানুষের সমাগম, উচ্চ শব্দে গানবাজনা করা, গাড়ির হর্ন দেওয়ার মতো বিব্রতকর পরিবেশ লক্ষ করা যায়। এ কারণে পাখি আসে না। আবার বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের বড় লেকটিতে আগে প্রচুর পাখি বসত। কিন্তু সংস্কারের অভাবে কচুরিপানায় ভরে গেছে। লেকটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবদুর রহমানের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক পরিষ্কার করা, পাড়ে বেড়া দেওয়া বা মানুষকে সতর্ক করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামান্য পরিমাণ বাজেট দেওয়া হয়। এ বছর লেকগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে এবং বাকি কাজগুলো করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।