জিয়াউল হক মোল্লা, মোহাম্মদ শোকরানা, বিউটি বেগম ও সরকার বাদল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি বগুড়া: বিএনপির বর্জনের পরও বগুড়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলের সাবেক চার নেতা পরাজিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই গড়ে তুলতে পারলেও অন্য দুজন এত কম ভোট পেয়েছে যে তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতে যাচ্ছে।
এই চার নেতা হলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক সদস্য ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানা, সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম। এর মধ্যে শোকরানা ও সরকার বাদল শোচনীয় পরাজয়ে জামানত হারাচ্ছেন।
সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ শোকরানা ২ হাজার ৯৮২ ভোট পেয়েছেন। তিনিসহ এ আসনে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাহাদারা মান্নান নৌকা প্রতীকে ৫১ হাজার ৪৯৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। মোট প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোটও না পাওয়ায় এ আসনে জামানত হারাচ্ছেন শোকরানাসহ সাত প্রার্থী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে বগুড়া-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ শোকরানা। ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর বিএনপি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শোকরানা জেলা বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন।
জামানত হারানো বিষয়ে মোহাম্মদ শোকরানা বলেন, ‘সারা দেশে ভোট নিয়ে যা হয়েছে, আমার আসনেও তাই হয়েছে। এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে বিউটি বেগম ট্রাক প্রতীকে ৩৪ হাজার ২০৩ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া এই আসনে জাতীয় পার্টি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ ৩৬ হাজার ৯৫২ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ আসনে সাত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে চারজন জামানত হারিয়েছেন।
বিউটি বেগম ২০১৪ সালে দলের সমর্থনে শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হলে তাঁকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
কয়েকজন ভোটার বলেন, এ আসনে প্রথমে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান। কিন্তু আসন ভাগাভাগির মারপ্যাঁচে শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন তৌহিদুর। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশ লাঙ্গল ঠেকাতে এককাট্টা হয়ে বিউটি বেগমের প্রচারণায় নামেন।
এরপরও পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে বিউটি বেগম বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা শেষ মুহূর্তে বেঈমানি করেছেন। আবার বিএনপির একটি অংশও ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন যে ভোট পড়েছে সেই ভোটের সিংহভাগ তাঁর পক্ষেই ছিল। কিন্ত ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে শেষ মুহূর্তে একটি ইউনিয়নে জাল ভোট দিয়ে বাক্স ভরে লাঙ্গলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-৪ আসনে ১৪-দলীয় জোটসমর্থিত জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের কাছে অল্প ভোটে হেরেছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা। নৌকা প্রতীকে রেজাউল করিম ৪২ হাজার ৭৫৭ ভোট পেয়েছেন। জিয়াউল হক মোল্লা ঈগল প্রতীকে ৪০ হাজার ৬১৮ ভোট পান। এ আসনে মোট ছয়জন প্রতিদ্বন্দিতা করেন। এর মধ্যে ডাব প্রতীকে বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমসহ চারজন প্রার্থী জামানত হারাচ্ছেন।
জিয়াউল হক মোল্লা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নির্বাহী সদস্য। এলাকার কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিয়াউল হক মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দলটির একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। জিয়াউল হকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ১৪ নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে দুজন ইউপি চেয়ারম্যানও রয়েছেন। বিএনপির নেতৃত্বে থেকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া নিষেধ থাকলেও জিয়াউল হককে ঠেকাতে বিএনপি-সমর্থিত অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দেন বলে এলাকায় আলোচনা আছে।
এ বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, ‘নৌকার প্রার্থীর পক্ষে ছিল না আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ। আবার বিএনপির একটি অংশও ঈগল প্রতীকের পক্ষে ছিল। কিন্ত ভোটে কালোটাকা ছড়ানো ছাড়াও নানামুখী ষড়যন্ত্র করে ঈগলের বিজয় ঠেকানো হয়েছে। আমার বিজয় ঠেকাতে বিএনপির কিছু লোকজন নৌকায় সিল মেরেছেন। তা ছাড়া নন্দীগ্রাম উপজেলায় কিছু কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে।’ এসব কারণে ভোট পুনর্গণনা চেয়ে রিটানিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন তিনি।
বগুড়া-৭ আসনে (গাবতলী ও শাজাহানপুর) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা আলম নৌকা প্রতীকে ৯১ হাজার ২৯ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির এ টি এম আমিনুল ইসলাম ৬ হাজার ৮০১ ভোট পেয়েছেন। এ আসনে ঈগল প্রতীকে প্রার্থী সরকার বাদল পেয়েছেন ২ হাজার ৫৯৩ ভোট। বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলু ট্রাক প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ৭ ভোট। সেই হিসাবে নৌকার প্রার্থী ছাড়া বাকি ১২ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সরকার বাদল ২০১৪ সালে বিএনপির সমর্থনে শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে বগুড়া-৭ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে পাননি তিনি। সর্বশেষ ২০২২ সালে বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন।
সরকার বাদল বলেন, ‘নজিরবিহীন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে, কেন্দ্র দখল করে ব্যালট কেটে বাক্সে ভরে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, বর্তমান সরকারের অধীন প্রহসনের পাতানো নির্বাচনের ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত ওই নেতারা জাতির সঙ্গে বেঈমানি ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাদের শুধু বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেনি, জনগণও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।