এবারের নির্বাচনে দেশি পর্যবেক্ষক শেষ পর্যন্ত কতজন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন | প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন অনুযায়ী, দেশি বিভিন্ন সংস্থার ২০ হাজার ৭৭৩ জন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে কতজন দেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। 

আগামীকাল রোববার ভোট গ্রহণ। তবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত অনেক সংস্থা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পর্যবেক্ষকদের নামের তালিকার অনুমোদন নেয়নি। আবার যাঁরা অনুমোদনের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে তালিকা দিয়েছেন, অযোগ্যতার কারণে তাদের অনেকে অনুমোদন পাননি। কোনো কোনো সংস্থা অনুদানের আশায় আছে। কেউ কেউ আবার পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়ার নাম করে টাকাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, এবার ইসি কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জনকে ভোট পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দিয়েছে। যাঁরা কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, তাঁদের নামের তালিকা অনুমোদন করে কার্ড দিয়ে থাকে ইসি সচিবালয়। আর যেসব সংস্থা স্থানীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, তাদের সংখ্যা ইসি অনুমোদন দিলেও নামের তালিকা ও পর্যবেক্ষক কার্ড দেবেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রয়োজনীয় দলিল জমা দিতে হয়। পর্যবেক্ষক হতে হলে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাস এবং ২৫ বছরের বেশি বয়সী হতে হয়।

দিনাজপুর জেলায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বেসরকারি চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৮ জনের তালিকা জমা পড়েছিল জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। এর মধ্যে লুৎফর রহমান ভুইয়া ফাউন্ডেশন থেকে ১৩ জন, বিয়ামমনি সোসাইটি থেকে ১১ জন, ডেভেলপমেন্ট হেল্পিং কি থেকে ১১ জন এবং দিনাজপুর পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টা থেকে ২৩ জনের তালিকা দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট হেল্পিং কি যাঁদের তালিকা দিয়েছিল, তাঁদের ৬ জনের এসএসসির সনদ ভুয়া। তাই তাঁদের আবেদন বাতিল করা হয়। বিয়ামমনি সোসাইটির ৫ জনের বয়স ২৫ বছরের নিচে হওয়ায় তা বাতিল হয়েছে। লুৎফর রহমান ভুইয়া ফাউন্ডেশনের আবেদন ফরমে অন্য সংস্থার নাম লেখা থাকায় ৫ জনের এবং ২৫ বছরের নিচে বয়স হওয়ায় ৪ জনের আবেদনপত্র বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুর পল্লী উন্নয়ন প্রচেষ্টা থেকে ২৩ জনের মধ্যে ৫ জনের বয়স ২৫ বছরের নিচে হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে। 

আবেদনকারীদের মধ্যে ১৪ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের ১ জন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক, কম্পিউটার কম্পোজের দোকান করেন ২ জন, উত্তরা ইপিজেডে চাকরি করেন ১ জন, ১ জন গৃহশিক্ষক এবং অন্যরা শিক্ষার্থী ও বেকার যুবক। এর মধ্যে ৬ জন জানিয়েছেন, তাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন। তাঁরা সবাই নিজের নির্বাচনী এলাকায় পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য আবেদন করেছেন। যদিও নীতিমালা অনুযায়ী, নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা বা ভোটার নন, এমন লোককে পর্যবেক্ষক হিসেবে মোতায়েন করার কথা।

দিনাজপুরের পর্যবেক্ষক যাচাই–বাছাই কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৮ জনের তালিকা তাঁরা পেয়েছেন। অধিকাংশই নীতিমালা অনুসরণ না করে আবেদন করেছেন। যাচাই–বাছাই শেষে ৩০-৩৫ জনের নামে কার্ড ইস্যু করা হবে। 

কুড়িগ্রামে যে সংস্থাগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চায়, সেগুলোর একটি গরীব উন্নয়ন সংস্থা। এই সংস্থার হয়ে ১৪৮ জন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা। গরীব উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো দাতা সংস্থা ও সরকারের আর্থিক সহায়তা পাননি। তাই নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়নি। প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁদের ভোটের মাঠে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পাঠাতে হবে। যাঁরা নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে তাঁর সংস্থার হয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

এই সংস্থার হয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হরিকেশ গ্রামের লক্ষণ চন্দ্র দাস। তিনি গতকাল বিকেলে বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য তিনি আবেদন করেন। তাঁর দাবি, সে সময় তাঁর কাছে ২০০ টাকা বিকাশে নেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কার্ড ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

বরিশাল বিভাগের তিন জেলার ১৪টি আসনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ‘সোসাইটি ফর রুরাল নিড’ (স্রাবন)। তাদের ১৮২ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪২ জন এবং স্থানীয়ভাবে ১৪০ জন পর্যবেক্ষণ করার কথা।

বরিশাল জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মনদীপ ঘরাই গতকাল শুক্রবার দুপুরে বলেন, ‘আমরা এখনো ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা হাতে পাইনি।’

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ও সাধারণ সম্পাদক সাকিব আহমেদ বলেন, তাঁরা নির্বাচন কমিশনে গত ১২ ডিসেম্বর ৪২ জনের তালিকা জমা দিয়েছিলেন। তাঁদের কার্ড এখনো হাতে পাননি। এ ছাড়া বাকি ১৪০ জনের তালিকা এখনো তাঁরা জমা দেননি। কারণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ‘প্রয়োজনীয় তহবিল’ এখনো পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

এবারের নির্বাচন সামনে রেখে যেসব দেশি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে ইসি নিবন্ধন দিয়েছিল, তাদের অনেকগুলোই নামসর্বস্ব ও ভুঁইফোড় সংগঠন। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, নির্বাচন এলেই ভুঁইফোড় ও আজগুবি কিছু প্রতিষ্ঠানের উদয় হয়। আগেও এমন নজির দেখা গেছে। এবারও ইসি যেসব প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করেছে, সেগুলো বাস্তবে কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান কি না কিংবা এদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, পরিচিতি, লোকবল আছে কি না, সেটি নিয়ে সংশয় আছে।