ড. মুহাম্মদ ইউনূস | ফাইল ছবি |
ড. মো. কামরুজ্জামান: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের দীক্ষামন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি ও বঙ্গনেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সাধিত হয়েছে প্রভূত উন্নয়ন। টানা তিন বারের নির্বাচিত আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার তৃতীয় মেয়াদ শেষ করে আরও একটি সুষ্ঠু ও সার্বজনীন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেয়ার দ্বারপ্রান্তে। এমনি একটি মাহেন্দ্রক্ষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক নেতৃবর্গের (বিশেষত: ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর বন্ধুপ্রতিম) অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয়েছিল; যাতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রীক আন্তর্জাতিক দূরভিসন্ধি স্পষ্টত প্রতীয়মান। সন্দেহ নেই যে, ড. মোহাম্মদ ইউনূসের শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি বাংলাদেশের জন্য একটি অনন্য অর্জন। তাই বলে ব্যক্তি ইউনূস ও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড প্রশ্নাতীত নয়। নানাবিধ জাতীয় ইস্যুতে তাঁর ভূমিকা নিয়ে আমি আগেও জাতীয় পত্রিকায় লিখেছি। অনেক বিদগ্ধ পাঠক সেটার সমালোচনাও করেছেন, তাতে আহত হইনি। ভেবেছিলাম তাঁকে নিয়ে আর হয়তো লিখতে হবে না। কিন্তু না, তাঁকে নিয়ে না লিখে পারলাম না। কারণ, বাংলাদেশের কিছু অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে তাঁর ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড আমার বিবেককে ভীষণভাবে তাড়িত করেছে। একজন বিবেকবান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নাগরিক হিসাবে সেই তাড়নায় অতীতের ধারাবাহিকতায় আবারও লিখছি।
ব্যক্তিগতভাবে অর্থনীতিবিদ হলেও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত দেড় দশকে বিভিন্ন সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ২০০৬ সালে নোবেল পাওয়ার পর ওয়ান—ইলেভেনে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার সময় রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ চেষ্টা; বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্থাপনা পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করা; বয়স না থাকলেও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ আঁকড়ে রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া; গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়া; শ্রম আইন অনুসরণ না করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের চাকরিচ্যুত এবং শ্রমিকদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা এবং মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কায় আদালতের বাইরে সেটেলমেন্টসহ এমডি থাকাকালীন রাষ্ট্রীয় বিধি বহির্ভূতভাবে বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও কথিত জাতীয় সরকারের প্রধান হওয়ার বিষয়েও একাধিকবার আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।
যখনই দেশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক সংকট তৈরি হয়েছে তখনি তিনি বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছেন। যাচনা করেছেন অযাচিত হস্তক্ষেপ, যা একটি দেশের সার্বভৌমত্বের উপর হুমকিস্বরূপ। প্রস্তাবিত তথাকথিত সরকারের প্রধান হয়ে জাতিকে উদ্ধার করার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাপ্রাপ্তির লালিত সুপ্তবাসনা। সেটি তিনি করতেই পারেন, বাংলাদেশের সংবিধান তাঁকে সেই অধিকার দিয়েছে। সাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করে সেই সুপ্তবাসনা পূরণের প্রত্যাশা তিনি করতেই পারেন। দেশে থেকে রাজনীতি করে নেতা হওয়া ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরকার প্রধান হওয়ার দ্বার দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত।
ওয়ান—ইলেভেনের সময় রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন ড. ইউনূস। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ড. ইউনূস দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার 'মাইনাস টু' পরিকল্পনায় ড. ইউনূসের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। ঐ বছরের ৩১ জানুয়ারি দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন বলে জানান। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দিয়ে নিজের রাজনীতি সম্পর্কে পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি দলের সম্ভাব্য নাম নাগরিক শক্তি’ বলে জানান। পরে বিভিন্ন গ্রামে, মহল্লায় এবং ওয়ার্ডে ২০ সদস্যের প্রাথমিক প্রস্তুতি টিম’ গঠনের আহ্বান জানান তিনি। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীদেরও এতে ব্যবহার করেন বলে ওই সময় অভিযোগ ওঠে। পরে অবশ্য জনগণের কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে ২০০৭ সালের ৩ মে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। এজন্য তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে উল্লেখ করেন, যাদের সঙ্গে পেলে দল গঠন করে জনগণের সামনে সবল ও উজ্জ্বল বিকল্প রাখা সম্ভব হতো, তাদের তিনি পাচ্ছেন না। আর যারা রাজনৈতিক দলে আছেন, তারা দল ছেড়ে আসবেন না। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এ পথে অগ্রসর না হওয়াই সঠিক হবে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন।
দেশে বিদ্যমান তথাকথিত রাজনৈতিক সংকট সমাধানে গত বছর (২০২২) মে মাসে দুই বছর মেয়াদি একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে তিন জনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন সেখানেও এক নম্বরে ছিল অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে ড. ইউনূসের ভূমিকা ছিল বলে সরকারের শীর্ষমহল থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। সরকার প্রধান মহান সংসদে পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রে যাদের নাম বলেছেন তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। পদ্মা সেতু ইস্যুতে তাঁর ভূমিকা দেশের আপামর জনসাধারণও প্রত্যক্ষ করেছে।
দেশের সুখ—দুঃখ, বন্যা, খরা, ঝড়—ঝঞ্ঝা ও করোনার মত মহাসঙ্কটেও দেশের মানুষের পাশে কখনোই তাঁকে দেখা যায়নি। করোনা মহামারীর মত একটি বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও দেশ আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে ড. ইউনূসের দৃশ্যমান কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা চোখে পড়েনি বা পড়ছে না। তাঁর উদ্ভাবিত গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের প্রকৃতি ও ক্ষুদ্রঋণ নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের উপকার বা বঞ্চণার বিষয়টিও এখনো দ্বান্দ্বিক। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকেরই নিঃস্ব বা ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার নজির পাওয়া যায়। এমনকি ঋণ পরিশোধের চাপ ও দায় থেকে মুক্তি পেতে প্রাণ বিসর্জনের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অমানবিকতার উদাহরণ রয়েছে বিস্তুর। অনেক ক্ষেত্রে কিস্তি আদায়ে সুবিধা—অসুবিধা বিবেচনায় না নেয়ায় গ্রাহকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে মানসিক বিকারের, মানবিক সঙ্কটের। এছাড়াও নাগরিক দায়িত্ব পালনেও ড. ইউনূসের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় অনাগ্রহ। তাইতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস কিংবা মহান বিজয় দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতেও শহিদ মিনার কিংবা জাতীয় স্মৃতিসৌধের চৌহদ্দিতেও তাঁকে দেখা যায় না কখনোই।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর প্রেক্ষাপটে একযোগে ১৮০ জন বিশ্বনেতা তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি’ দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি থেকে দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর; অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক—কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ লোপাট; শ্রমিক—কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের সময় অবৈধভাবে আইনজীবীর ফিসহ অন্যান্য ফিয়ের নামে ছয় শতাংশ অর্থ কর্তন; শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের বরাদ্দকৃত সুদসহ ৪৫ কোটির অধিক টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ করার মত গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ দুইজন পরিচালকের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, শ্রমিকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ এসব অভিযোগ জানিয়ে দুদককে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছিল শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। সেই প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুদক। উল্লেখ্য, এর আগে অবসর গ্রহণের সময়সীমা নিয়ে বিতর্কের পর ২০১১ সালে আদালতের রায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারিত হন ড. মুহম্মদ ইউনূস।
শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় ২৮ আগস্ট ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ২০০৬ সালের আগে গ্রামীণ টেলিকমে নিয়োগ পাওয়া ১৮ কর্মচারী বাদী হয়ে পৃথক এ মামলাগুলো করেন। এর আগে গত ৩০ মে ড. ইউনূসকে প্রধান আসামি করে আরও ১২ জনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক—কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ জন কর্মচারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ১১০টি মামলা করেছিলেন। এর মধ্যে শ্রম আদালতে ১০৪টি ও হাইকোর্টে ছয়টি মামলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ৪৩৭ কোটি টাকা দাবি করে মামলা করেছিলেন ওই শ্রমিকগণ। প্রায় পাঁচ বছর ধরে মামলা চলার পর ২০২২ সালের মে মাসে আদালতের বাইরে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ১১০টি মামলার সবকয়টি প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস দানকর মামলায় উচ্চ আদালতে পরাজিত হয়ে ১২ কোটি টাকার বেশি দানকর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের একটি অভিযোগ তদন্ত করেছে। সেই অভিযোগে বলা হয়েছে যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্যদের যোগসাজশে ৫ হাজার কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকম থেকে পাচার করেছেন।
ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্বনেতাদের খোলা চিঠি, টুইট ও বিবৃতির মধ্যে নতুন করে ১৮টি মামলা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে ১০০ জন নোবেল বিজয়ীসহ ১৮০ জন বিশ্বনেতা বিচার স্থগিত চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠিদাতাদের মধ্যে বারাক ওবামা, শিরিন এবাদি, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও রয়েছেন। চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় পূর্ণ পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে বিশ্লেষকগণ বিভিন্নভাবে মতামত তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন অনেকেই। কেননা সচরাচর কোন বিষয়ে বিবৃতি বা খোলাচিঠির বিষয়ে দেখা যায়, চিঠির সারমর্ম পত্রিকায় প্রকাশ করে স্বাক্ষরকৃতদের নাম প্রকাশ করা হয় তাও ভেতরের পৃষ্ঠার দিকে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টে যেভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে পূর্ণপাতা দখল করে খোলা চিঠির বিষয়ে বিশ্ব জনতাকে অবগত করার চেষ্টা করা হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন, দাপ্তরিক রীতি ব্যবহার করা উচিত ছিল বিশ্ব নেতৃবৃন্দের, কিন্তু ব্যাপারটিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার একটি অপচেষ্টাও এতে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসকে সামনে নিয়ে আসার ব্যাপারটিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অনেকেই আখ্যায়িত করেছিলেন।
ইউক্রেন—রাশিয়ার ও ফিলিস্তিন—ইজরাইল যুদ্ধে এখনো যারা মদদ দিয়ে যাচ্ছেন বা বিভিন্নভাবে সহায়তা করে চলছেন তাদের বিরুদ্ধে উল্লিখিত বিবৃতিদাতাদের মনোকষ্টের বালাই নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও তাদের মনোকষ্ট হচ্ছে না। ইউক্রেন—রাশিয়ার ও ফিলিস্তিন—ইজরাইল যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত করেছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ড. ইউনূসের পক্ষে যারা বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেক দেশের রাষ্ট্রনেতারা এ যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য সহযোগিতার দ্বার অবারিত রেখেছেন। সে বিষয়ে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই, অথচ ড. ইউনূসের পক্ষে তারা বিবৃতি দিয়েছিলেন। দলমত নির্বিশেষে পুরো বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চিন্তিত, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার জন্য বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানিয়েছে, সে বিষয়ে ৪০ জন বিশ্বনেতার প্রো-অ্যাকটিভ কোনো ভূমিকা নেই। সে কারণেই বাংলাদেশিরা মনে করে, ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্ব নেতাদের বিবৃতি দূরভিসন্ধিমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করার অপপ্রয়াস মাত্র। ড. ইউনূসকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের’ বিষয়ে গত ২৯ আগস্ট গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন— আত্মসম্মান না থাকায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি বিবৃতি ভিক্ষা করেছেন। তিনি বিচার বন্ধের কথা না বলে বিবৃতিদাতা বিশ্বনেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশে এক্সপার্ট পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যদি এতই দরদ থাকে তারা ল—ইয়ার পাঠাক। মামলার সব দলিল দস্তাবেজ খতিয়ে দেখুক। তারাই দেখে বিচার করে যাক এখানে কোনও অপরাধ আছে কিনা। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে মন্তব্য করে ড. ইউনূসের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভদ্রলোকের এতই যদি আত্মবিশ্বাস থাকতো যে তিনি কোনও অপরাধ করেননি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। “ মামলায় সরকারের কোনও হাত নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মামলা তারা (সরকার) করেননি। তিনি বলেছিলেন, আদালত স্বাধীনভাবেই কাজ করবে। আদালত ন্যায় বিচার করবে। আদতে হয়েছেও তাই। সম্প্রতি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় তাকে ও তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন শ্রম আদালত। মামলার নথিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠনটির ৬৭ কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ ছাড়াও, কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি। কোম্পানির লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়ার কথা থাকলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। বিচারের রায় মনোপূত হয়নি তাঁর। তা নাই হতে পারে। তিনি নিম্ন আদালতে পূণরায় রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করতে পারেন। এমনকি, উচ্চ আদালতের দ্বারও তাঁর জন্য উন্মুক্ত। সুতরাং বিচারের রায় নিয়ে বিষোদ্গার বা উষ্মা প্রকাশের সুযোগ নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিতের দাবির প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৭১ জন বিশিষ্ট নাগরিকও। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক, শিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, কবি, লেখক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মানবাধিকারকর্মী, নারীনেত্রীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা। বিবৃতিতে বলা হয়, “সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিভিন্ন দেশের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের সদস্যের লেখা খোলা চিঠি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। উক্ত খোলা চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর স্পষ্ট হুমকি হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। চিঠিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর এ ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।” ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়— ওই চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) স্বীকৃত শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই চিঠিতে ‘নিরপেক্ষ’ বিচারকের মাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিচারের যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করার শামিল বলে আমরা মনে করি। খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা প্রত্যাশা করি, বিবৃতিদাতারা তাঁদের নিজ নিজ দেশের মতো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকেও নিজস্ব আইন অনুযায়ী চলার সুযোগ দেবেন এবং সম্মান করবেন।
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের পক্ষ হতে বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতি উদাত্ত আহবান থাকবে, বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় আপনারা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিবেন। কারও প্রতি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে নিজেদের মর্যাদা খাটো করবেন না। আর যাদের পক্ষে আপনারা দাঁড়াবেন নিশ্চিত করে নিবেন, প্রকৃতার্থে ঘটনার আদ্যোপান্ত কী। সম্পূর্ণ ঘটনার বিষয়বস্তু জেনে—বুঝেই মতামত প্রদান করা শ্রেয়। সরকার কারও উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে না, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও অন্য যেকোনো আমলের তুলনায় উন্নতির দিকে— বিষয়টি বিভিন্ন সংস্থা নিশ্চিত করেছে। ইত্যবসরে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসকে নিয়ে যতগুলো মামলা—মোকদ্দমা হয়েছে আদালতের মাধ্যমে সেগুলো নিষ্পত্তির ব্যবস্থা হয়েছে, সেসব জায়গায় সরকার কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। আর তদন্তাধীন বিষয়ে বিদেশি বন্ধুদের এভাবে নাক গলানো রাষ্ট্রের আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ ও ধৃষ্টতার শামিল বলেই প্রতীয়মান। এভাবে একটি সরকারের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার অপসংস্কৃতি থেকে বিশ্বনেতৃত্ব সরে আসবে বলেই আমরা বিশ্বাস রাখি। বৈশ্বিক সমতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশে থাকবে। দেশপ্রেমিক সকল বাঙালি অতীতের ন্যায় ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর।
লেখক: অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কার্যকরী সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি ও সদস্য, বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।