কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠছেন যাত্রীরা। শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশনে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি কক্সবাজার: ৪৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে আজ শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো ট্রেনের যাত্রা। এরই সঙ্গে অবসান ঘটল কক্সবাজারবাসীর অপেক্ষার প্রহর। দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে সৈকতের শহর কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন থেকে ১ হাজার ২০ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় ২০ বগির ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’।
এ ট্রেনযাত্রার উদ্বোধন করেন রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর। ওই ট্রেনে তিনি যাবেন চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ট্রেন ছাড়ার আগে রেলসচিব সাংবাদিকদের বলেন, কক্সবাজারের প্রথম ট্রেনযাত্রায় ১ হাজার ২০ যাত্রী ইতিহাসের সাক্ষী হলেন। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙাভাব ফিরে আসবে। ট্রেনের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে আগামী ১০ দিনের টিকিট অগ্রিম কাটা হয়ে গেছে। সংকট নিরসনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানসহ রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাতে কক্সবাজার এক্সপ্রেসের সময় লাগবে ৮ ঘণ্টা ১০ মিনিট। প্রায় ১ হাজার ৩০০ যাত্রী নিয়ে আজ রাত সাড়ে ১০টায় ট্রেনটি পুনরায় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা করবে। ঢাকা থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজার নেমে পর্যটকেরা লাগেজ ও মালামাল রেলস্টেশনে রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরতে পারবেন নিজ গন্তব্যে।
কক্সবাজার–ঢাকা ট্রেন চলাচল নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মিত হয় ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ছয় তলাবিশিষ্ট এই আইকনিক রেলস্টেশন। গত ১১ নভেম্বর দুপুরে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের আইকনিক রেলস্টেশনসহ ১০১ কিলোমিটারের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রথম ট্রেনযাত্রা দেখতে আজ সকাল থেকে আইকনিক রেলস্টেশনে মানুষজনের ভিড় বাড়তে থাকে। রেলস্টেশনে কথা হয় কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। রেলপথ চালুর ঘটনাকে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শত বছর ধরে আমরা রেলপথ চালুর স্বপ্ন দেখে আসছিলাম, আজ তার বাস্তবায়ন দেখতে পারছি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কক্সবাজারবাসী কৃতজ্ঞ।’
স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়েসহ পাঁচজনের দল নিয়ে ট্রেনে চেপে ঢাকা যাচ্ছেন কক্সবাজারে কর্মরত জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তা ইফতিয়ার উদ্দিন বায়েজিদ। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো কাজকর্মে নয়, প্রথম ট্রেনে চড়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছি। কক্সবাজারে রেল আসবে—এটা ছিল আমাদের স্বপ্ন।’ আগামীকাল ট্রেনে তাঁরা আবার ফিরে আসবেন।
প্রথম ট্রেনযাত্রার অভিজ্ঞতা নিতে ঢাকায় রওনা দেন কক্সবাজার শহরের চিকিৎসক দম্পতি নাজমুল হক ও নীনা জিহান। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যাপক জেবুন্নেছা। নাজমুল হক বলেন, কক্সবাজার থেকে প্রথম ট্রেনে চড়ে ঢাকায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে। জেবুন্নেছা বলেন, কোনো কাজে নয়, আনন্দ উপভোগ করতে ট্রেনযাত্রায় শামিল হওয়া।
ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শোভন চেয়ারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯৫ টাকা। এসি চেয়ারের ভাড়া ১ হাজার ৩২৫, এসি সিটের ভাড়া ১ হাজার ৫৯০ ও এসি বার্থের ভাড়া ২ হাজার ৩৮০ টাকা। অপর দিকে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শোভন চেয়ারের ভাড়া ২০৫ টাকা, স্নিগ্ধা শ্রেণির ৩৮৬, এসি সিটের ৪৬৬ ও এসি বার্থের ভাড়া ৬৯৬ টাকা।
কক্সবাজার এক্সপ্রেসের চালক (লোকোমাস্টার) ছিলেন এফ এম আবদুল আওয়াল। তিনি বলেন, কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন থেকে প্রথম বাণিজ্যিক ট্রেনের চালক তিনি, এটা ভাবতে অবাক লাগছে। দেশের এত জায়গায় গেছেন তিনি, কিন্তু দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথ দেখেননি কোথাও। সবুজ পাহাড়, সুপারিবাগান, সবুজ মাঠ, নদী-বিলের ভেতর দিয়ে চলে ট্রেন। দারুণ উপভোগ্য।
ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় কক্সবাজারের দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে জানিয়ে কক্সবাজারের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ইতিমধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনেও। রেলপথ পর্যটনে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে জানিয়ে তিনি বলেন, কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ, সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ, টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানির মালামাল পরিবহনে সুবিধা বাড়বে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের।
রেলস্টেশনের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ, রেল পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। ফুল ও চকলেট দিয়ে তাঁরা যাত্রীদের বরণ করেন। রেলস্টেশনে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক) আপেল মাহমুদ বলেন, পর্যটকসহ যাত্রীদের নিরাপত্তার পাশাপাশি ট্রেনে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান যেন না হয়, সেদিকেও বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।
কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার গোলাম রব্বানি বলেন, প্রথম যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন ১ হাজার ২০ যাত্রী। কক্সবাজার এক্সপ্রেসে বগি লাগানো হয়েছে ২০টি। অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রেলপথ। সড়কপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে অনেকেই ট্রেনে যাওয়া-আসা করছেন।
ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, রেলপথ চালুর পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কপথে মানুষের চাপ, দুর্ভোগ ও দুর্ঘটনা কমে আসবে। ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় শহরের পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সেবার মান বাড়ানো হচ্ছে।
আইকনিক রেলস্টেশনে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সুবিধা। দৈনিক ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আইকনিক রেলস্টেশনে আরও আছে ডাকঘর, কনভেনশন সেন্টার, তথ্যকেন্দ্র, এটিএম বুথ ও প্রার্থনার স্থান।