প্রতিনিধি ঈশ্বরদী: তিন বছর ধরে হার্টের সমস্যা ও পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে শয্যাশায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক আলী বিশ্বাস। শরীর নিয়ে উঠে বসতে পারেন, তবে একেবারেই চলাচল করতে পারেন না। বাড়িতে আগন্তুক আসার খবরে উঠে বসেন। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলেন, ‘স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাতনিসহ টিনের ঘরে কোনো রকম দিন কাটাইছি। একটা ঘরের ভেতরেই অসুস্থ শরীর নিয়া পড়ে থাকতাম। তবে বছরখানেক ধরে ছাদের নিচে পাকা ঘরে আছি।’
ছাদেক আলী বিশ্বাসের (৭৬) বসবাস পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা শহরের বড়ইচারা স্কুলপাড়া গ্রামে। সেখানে তাঁর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে পাকা বাড়ি। যার কেতাবি নাম ‘বীর নিবাস’। সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি।
শেষ জীবনে পাকা বাড়িতে থাকাকে সৌভাগ্য মনে করেন দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা হাবিবুর রহমান হবি। মহান বিজয় দিবসের দিনে নিজ ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, কখনো ভাবেননি জীবনের শেষ বয়সে পাকা ঘর পাবেন। তা-ও আবার মেঝে টাইলস্ করা। এটা আমার সৌভাগ্য।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগে খুশি হবির স্ত্রী আফরোজা বেগম। তিনিও বলেন, ‘আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সবকিছুই পাইছি। তবে চিকিৎসার ব্যাপারটা একটু দেখলে আরও খুশি হইতাম।’
বড়ইচারা গ্রামে রয়েছে আরও একটি বীর নিবাস। সেটি বীর মুক্তিযোদ্ধা বাখের আলীর নামে। ৭৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে বাখের আলীর নামে করা বীর নিবাসে এখন থাকছেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা। স্ত্রী মাজেদা খাতুন বলেন, স্বামী জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করছিল। তিনি নাই। তবে সরকার তাঁর ওয়ারিশদের সুবিধা দিছে। মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর কল্যাণে এখন ছাদের নিচে থাকি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম মিন্টু বলেন, সরকারিভাবে বীর নিবাস নির্মাণ করে তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ঘরগুলোয় সব ধরনের আধুনিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বীর নিবাস পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী উপজেলায় তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭৩১ জন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। দুই ঈদে ১০ হাজার করে ২০ হাজার টাকা উৎসব ভাতা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। সব বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও সরকার বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে এই উপজেলায় ৯৪ জন অসচ্ছলদের। পাকা বাড়িগুলো একতলা। দেয়াল ইট ও সিমেন্টের। ছাদ পাকা। প্রতিটি বীর নিবাসের আয়তন ৭৩২ বর্গফুট। একেকটিতে দুটি শয়নকক্ষ, একটি বসার কক্ষ (ড্রইংরুম), একটি খাওয়ার কক্ষ (ডাইনিং), একটি রান্নাঘর, একটি বারান্দা ও দুটি শৌচাগার রয়েছে।
প্রতিটি বাড়িতে থাকছে একটি উঠান, একটি নলকূপ এবং গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনের জন্য আলাদা জায়গা ও ছাউনি। প্রথম ধাপে একেকটি বাড়ি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় ধাপে ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।
সরকারের একটি কমিটি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করে। কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। নিয়ম অনুযায়ী, অসচ্ছল বীরাঙ্গনারা সরাসরি পাকা বাড়ি বরাদ্দ পাবেন। অসচ্ছল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রাধিকার পাবেন। অগ্রাধিকার তালিকায় আরও রয়েছে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার অসচ্ছল স্ত্রী ও সন্তানেরা।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার দাশ বলেন, অসচ্ছল বিবেচনায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাস তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগ পর্যায়ক্রমে আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য নিশ্চিত করা হবে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী বিশ্বাস বলেন, সরকার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পাকা বাড়ি উপহার দিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।
পাবনা-৪ আসনের সংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, প্রকল্পটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের প্রকল্প।