মেহেদী আহমেদ আনসারী |
মেহেদী আহমেদ আনসারী: এবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ। এটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী হয়ে সিলেট পর্যন্ত আমাদের ভূ-অভ্যন্তরে বিস্তৃত একটি চ্যুতি রেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর হয়তো এর আগে কোনো মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল না। তবে বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ভূমিকম্পে হয়তো হাজার হাজার বাড়িঘর ভেঙে পড়বে না, রাস্তাঘাট ধসে যাবে না, কিন্তু ভবনের দেয়ালে ফাটল ধরা ও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। এটা আমরা এবারের ভূমিকম্পের সময় কুমিল্লা ও ঢাকায় দেখেছি।
মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কিন্তু এমন আতঙ্ক তৈরি হওয়ার কথা নয়। দেশে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড মেনে কেউ যদি ভবন নির্মাণ করে, তাহলে ছয় মাত্রার ভূমিকম্পেও ভবনের ক্ষতি হওয়ার কথা না।
যেহেতু ফাটল ধরছে, আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে, তার মানে দেশে ভবন ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করা হচ্ছে না। এগুলো যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্প ছাড়াই দেশে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকায় ভবন ইমারত বিধিমালা মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। তারা যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করত, তাহলে দেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে ফাটল ধরত না।
আমরা দেখেছি বিদেশে কোনো বড় ভূমিকম্প হলে এবং মানুষের মৃত্যু হলে বাংলাদেশে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নড়েচড়ে বসেন। তাঁরা নতুন নতুন কমিটি করেন। কমিটি সুপারিশ তৈরি করে। কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁরা সবকিছু ভুলে যান।
তুরস্কে গত ফেব্রুয়ারিতে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এতে হাজার হাজার মানুষ ভবনধসে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যাস। তাঁদের উদ্ধার করার সুযোগই পাওয়া যায়নি। এরপর বাংলাদেশে সরকারকে তৎপর হতে দেখেছি। তখন সরকার উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটি ভূমিকম্প হলে কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছে।
ভবনগুলোর ভূমিকম্প ঝুঁকি চিহ্নিত করার খুবই সাধারণ ও মৌলিক একটি উদ্যোগের সুপারিশ আমরা করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, ঢাকার ভবনগুলোর ভূমিকম্প সহনশীলতা নিরূপণ করে ঝুঁকির মাত্রা বের করে। সে অনুযায়ী ভবনে রং করে দেওয়া। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে লাল, মাঝারি ঝুঁকির ভবনে হলুদ এবং কম ঝুঁকির ভবনে সবুজ রং দিয়ে দেওয়া যায়, যাতে মালিকেরা আর্থিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে হলেও ভবনগুলোকে ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করেন।
যাঁরা কোটি টাকা খরচ করে ভবন বানাচ্ছেন, তাঁরা কেন সামান্য বাড়তি ব্যয় করে সেগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করবেন না, এই প্রশ্ন সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকেও উঠতে হবে। সরকারকে ভবনমালিকদের সহযোগিতা ও চাপ প্রয়োগ দুটিই করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সরকারকে করতে হবে, সেটি হলো স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা। দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৬০ হাজারের ওপর স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা আছে। কিন্তু শহরে ভূমিকম্পের পর উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নেই।
আমরা রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দেখেছি, ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরা উদ্ধার তৎপরতায় বড় ভূমিকা রেখেছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মকাণ্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
ভূমিকম্প এমন একটি দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেওয়া এবং থামানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের অবকাঠামোগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করা এবং দুর্ঘটনার পর উদ্ধার তৎপরতাই এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে বলে আমি মনে করি।
লেখক: অধ্যাপক, বুয়েট ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ