সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার রিকশা পেইন্টারদের একটি দলকে সম্মান জানিয়ে ‘গ্যালারি অন হুইলস’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কসমস ফাউন্ডেশন। বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর বারিধারার ব্যক্তিগত জাদুঘরে কসমস ফাউন্ডেশনের শিল্প শাখা গ্যালারি কসমসে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্রকে’ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খানের সঞ্চালনায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত লিও টিটো এল আউসান জুনিয়র, কসমস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী এবং কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু, সৈয়দ আহমেদ হোসেন, এস এ নূর আলী, মো. মনির হোসেন ও মোহাম্মদ সোলেমানসহ বিভিন্ন রিকশা চিত্রশিল্পী ও দেশি-বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ ইউনেসকোর ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি ঐতিহ্যের তালিকায় এই উল্লেখযোগ্য অন্তর্ভুক্তিকে সম্মান জানাতে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য রিকশা চিত্রশিল্পীদের এবং কসমস ফাউন্ডেশনকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এ বছর আমরা ঢাকায় আমাদের ঐতিহ্যবাহী (স্বাধীনতা) কুচকাওয়াজের অংশ হিসেবে “অ্যাডর্ন-আ-রিকশা” শিরোনামের একটি অনন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। যা ছিল আমাদের দেশের আইকনিক বাহনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আমাদের সমৃদ্ধি ও ফিলিপিনো উৎসবের রং।’
অনুষ্ঠানটি যে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে এবং ফিলিপাইনের ‘আতি আতিহান’ উৎসবের মতো বিশ্বব্যাপী ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোর কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত লিও বলেন, এই অর্জন উদ্যাপনের জন্য বাংলাদেশেরও একটি রিকশা-থিমভিত্তিক বার্ষিক উৎসব হওয়া উচিত।
কসমস ফাউন্ডেশনের সভাপতি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যখন আমরা বড় হয়েছি, আমরা পেছনে প্রাণবন্ত ও অর্থবহ চিত্রকর্ম সংবলিত রিকশা দেখেছি এবং সব সময় উপলব্ধি করেছি যে এই কাজের উল্লেখযোগ্য শৈল্পিক মূল্য রয়েছে। আমি এনায়েতউল্লাহ খান ও কসমসকে অভিনন্দন জানাতে চাই এটি উপলব্ধি করার জন্য এবং আজ রাতে আমাদের সামনে এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য। এই শিল্প আমাদের জীবদ্দশায় বহু দূরে এগিয়ে যাবে। কারণ, রিকশা ও রিকশাচিত্র যানবাহনের চেয়ে বেশি, ঢাকা ও এর জনগণের সঙ্গে একধরনের অনন্য ও চিরায়ত বন্ধন রয়েছে। এটি সেই সম্পর্কের সারমর্ম, যা সহজাতভাবে কখনো ফিকে হওয়ার নয়, ইউনেসকো একেই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং আমরা আজ এখানে তা উদ্যাপন করছি।’
অনুষ্ঠানে এনায়েতউল্লাহ খান এই অর্জনের প্রশংসা করে বলেন, ‘ডিসেম্বর আমাদের জন্য বিজয়ের মাস এবং এই বছর আমরা আরেকটি বিজয় অর্জন করেছি। কারণ, ইউনেস্কো আমাদের রিকশা চিত্রকর্মকে তার ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব জানতে পেরেছে, শিল্পের এই ধারা কতটা সৃজনশীল, প্রাণবন্ত ও রঙিন।’
এনায়েতউল্লাহ খান আরও বলেন, ‘১৯৩৮ সালের দিকে ঢাকা শহরে প্রথম রিকশা আসে এবং জাপান যখন জ্বালানিসংকটে ছিল, তখন প্রথম এই পরিবহন চালু হয়েছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন রিকশায় চড়ে সামনের দিকে তাকালে চলন্ত রিকশার পেছনের চিত্রকর্ম দেখতাম। প্রায়ই আমরা সিনেমার বিজ্ঞাপন বা বিশ্বের আকর্ষণীয় স্থান বা বিভিন্ন প্রাণীর ছবি এবং মনোরম, নৈসর্গিক সৌন্দর্য বা কখনো কখনো জ্ঞানমূলক উদ্ধৃতি দেখতাম!’
সারা বিশ্বে রিকশা পেইন্টিং প্রচারের বিস্তৃত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে এনায়েতউল্লাহ খান বলেন, ‘আমি বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে ভ্রমণ করেছি, কিন্তু আমি কখনো আমাদের মতো সৃজনশীল জাতি দেখিনি। আজ, আমরা আমাদের থাকার জায়গা, বাথরুম ইত্যাদিতে অসংখ্য রিকশা পেইন্টিং মোটিফ দেখতে পাই। আমরা চাই, বিশ্বের সবাই আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানুক।’
অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় রিকশাচিত্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এনায়েতউল্লাহ খান আরও বলেন, ‘তাই আমরা জাতির অর্জন বাড়াতে সাহায্য করার জন্য একটি বার্ষিক রিকশা পেইন্টিং উৎসবের আয়োজন করতে চাই। এ জন্য আমরা আমাদের কসমস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যাপক গবেষণা করব। আমরা ভবিষ্যতে রিকশা পেইন্টিংয়ের ওপর বই, ছোট ডকুমেন্টারি এবং অন্যান্য সৃজনশীল কাজের প্রকাশনার মাধ্যমে ফলাফলগুলোকে উপস্থাপন করতে চাই। আমাদের কসমস ফাউন্ডেশন এবং গ্যালারি কসমসের মতো শিল্পকলা শাখার মাধ্যমে আমরা সব সময় এভাবেই বাংলাদেশের প্রচার করি।’
শিল্পীরা তাঁদের বেশ কিছু রিকশা পেইন্টিং, পোস্টার ও রিকশা পেইন্টিং-থিমযুক্ত পণ্য প্রদর্শন করেন। তাঁরা তাদের মহিমান্বিত ও প্রাণবন্ত শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপনার মাধ্যমে অতিথিদের বিমোহিত করেন।
প্রধান শিল্পী মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু অনুষ্ঠানটি আয়োজনের জন্য কসমস ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘মজার বিষয় হলো ডিজিটাল মিডিয়া এবং ডিভাইসগুলোর কারণে যদিও আমাদের সুযোগ কমেছে, তবে এই সময়েই আমাদের শিল্প সীমানা ছাড়িয়ে গেছে এবং এই ডিজিটাল মাধ্যমের কল্যাণেই ইউনেসকো থেকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা পেলে আমরা আমাদের রিকশা পেইন্টিংগুলোকে অকল্পনীয় উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।’