পুনরায় শীতের মৌসুমে

গরম কাপড় পরে কাজে বেরিয়েছেন এক ব্যক্তি। শনিবার সকাল নয়টায় পঞ্চগড় পৌরসভার জালাসী এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

কাজী আলিম-উজ-জামান: শাহবাগের সড়ক ধরে মঙ্গলবার বিকেলে রমনা উদ্যানে প্রবেশ করে মনে হলো, বৃক্ষরাজি সব চোখ বুজে আছে। যেন অবসন্ন দেহে দীর্ঘ ঘুমের প্রস্তুতি। নতমুখী পাতারা বলে দিচ্ছে, শীত চলে এসেছে। এখন ওদের কুঁকড়ে থাকার দিন। পৌষ, মাঘ পার হয়ে ফাল্গুন এলেই জেগে উঠবে পাতারা, কুঁড়ি আসবে, ফুলেরা হাসবে।

বাংলার প্রকৃতিতে শীত ঋতু চলেই এল। কোনোবার সে আসে ধীরে পায়ে। এবার যেন শীতের বুড়ি ঠক ঠক শব্দে লাঠি ভর করে একটু সকাল সকাল হাজির হলো।

আজ পৌষ মাসের দ্বিতীয় দিন। পঞ্জিকার পাতায় পৌষ মাস আসার আগেই গত সপ্তাহে উত্তরের জেলাগুলোতে ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কুয়াশায় ঢেকে ছিল শর্ষেখেতের হলুদ রং। গ্রামের মোড়ে, বাড়ির উঠানে খড়কুটায় আগুন জ্বালিয়ে শীতে উষ্ণতা নেন নিরন্ন মানুষ। সকালে তামাকখেতে কাজ করতে যাওয়া বাবুল হোসেনের কথায়, ‘বৃষ্টির মতন কুয়াশা বাহে। হিম বাতাস, মাঘ মাসি শীতের মতন ঠান্ডা নাগেছে। জাড় মাঠোত টিকা যায়ছে না।’ তবে চলতি সপ্তাহে আবার অন্য চিত্র। পঞ্চগড় থেকে সাংবাদিক রাজিউর রহমান জানালেন, রাতভর উত্তরের হিমেল বাতাসে অনুভূত হয় কনকনে শীত। সকালে (শনিবার) দেখা মিলেছে ঝলমলে রোদের।

রংপুর অঞ্চলে শীতের অপর নাম ‘জাড়’। কত কবিতা, গল্প কিংবা চলচ্চিত্রের সংলাপে মহিয়ান হয়েছে এ শব্দ।

এ দেশে শীত ঋতুর অনুভূতিতে বোধ করি অঞ্চলভেদে রকমফের আছে। আমরা চোখ বন্ধ করলেই শৈশব-কৈশোরের শীত দেখতে পাই। পৌষ মাসের ভোর। শিউলিতলায় কিছু ঝরা ফুল। তাজা ঘ্রাণের মৌতাত। তীব্র শীত-কুয়াশার মধ্যেই গাছিভাইয়েরা ছুটছেন রস পাড়তে। একটার পর একটা কলসি (খুলনা-যশোর অঞ্চলে বলা হয় ঠিলা) নামছে। রস জ্বাল হচ্ছে তাফালে। ঝোলা গুড়ের সেকি মনমাতানো ঘ্রাণ! আবার ঘরের ছেলে-বুড়ো সবার হাতে গ্লাসভর্তি ঠান্ডা কাঁচা রস। কোনো বাড়িতে রসের পিঠা বানানোর তোড়জোড়।

চোখ বন্ধ করলে আরও দেখতে পাই, ভোরবেলা আগের রাতের কড়কড়ে ভাত আর জমে যাওয়া ব্যঞ্জন দিয়েই সারা হচ্ছে সকালের নাশতা। কারণ, শীতের ভোরে রান্নার ফুরসত হয় না অনেক পরিবারেই।

একটু বেলা গড়াতেই গৃহস্থ বাড়িতে ধান সেদ্ধ, শুকনা করার কাজে ব্যস্ত ঘরের কুলবধূরা। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলতেই আবার শীত শীত অনুভূতি। বিকেলে মাঠে মাঠে ভলিবল, ক্রিকেট, দাঁড়িয়াবান্ধা, এক্কাদোক্কা খেলা।

এ সময় বিল-ঝিলে পানি কমে আসে। কচুরিপানা সরিয়ে এক দল মানুষের কই, শিং, মাগুর, শোল মাছ ধরার আয়োজন। মুখর গ্রামীণ জনপদ।

আর শীতের রাত, সে যেন ফুরাতেই চায় না। জীবনানন্দের কবিতার মতোই, ‘এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/ বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,/ কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’

এখন শীতের চরিত্র কিছুটা বদলেছে বটে। খেজুরগাছও এখন আক্রা। তবু যেটুকু টিকে আছে, তাতে হাঁড়ি বা কলসি বাঁধা শুরু হয়েছে। রসও নামছে। যশোরের কেশবপুর থেকে তরুণ লেখক সৌমেন্দ্র গোস্বামী বলছিলেন, খেজুরের রস বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের শীতের সংস্কৃতির অংশ। কালিকাপ্রসাদের সেই গানের মতো, ‘খেজুরগাছে হাঁড়ি বাঁধো মন।’ এবার শীতও চলে এসেছে আগে আগে। কাঁচা রসও খাওয়া চলছে। নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে গাছিভাইদের অনেকেই কলসির ওপর নেট দিয়ে রাখছেন, যাতে বাদুড় মুখ দিতে না পারে। যদিও চিকিৎসকদের ভাষ্য—বাদুড়ের লালা এবং প্রস্রাব রসে গিয়ে পড়ে। মশারি বা জাল দিয়ে এর সুরক্ষা সম্ভব নয়। তাই রস খাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতনতা কাম্য।

শীতকাল চিরকালই বিয়েশাদির মৌসুম। ‘কী কী জিনিস এনেছ দুলাল বিবি সখিনার লাইগা, এনেছি এনেছি সিতার সিং, ভালো কাগজে মুড়িয়া’, বিয়ের অনুষ্ঠানে এ রকম গীত সারা বাংলাদেশেই কমবেশি চলত, যা এখন উঠে গেছে প্রায়। জায়গা হারিয়েছে লোকসংস্কৃতি।

ঢাকায় শীত কই, শীত তো সব গ্রামে, এমন আফসোসের কথা কান পাতলেই শোনা যায়। তবে রাজধানীতে কিন্তু শীত এসে গেছে। কমছে রাতের তাপমাত্রা। বাইরে বেরোলেই মোটা শীতপোশাক গায়ে চড়াতেই হচ্ছে। করপোরেট অফিসগুলোতে শুরু হয়ে গেছে পিঠা উৎসব, চলছে ‘হাঁস পার্টি’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেসে যাচ্ছে সেই সব ছবি আর ভিডিওতে।

এরপরও ঢাকার এমন শীতে যাঁদের চলছে না, তাঁরা বেরিয়ে পড়তে পারেন উত্তরবঙ্গের পথে শীত উদ্‌যাপনে। মোটা কাপড় সঙ্গে নেবেন। পথে যদি শীতে কাঁপতে থাকা কাউকে দেখেন, তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেবেন একটি। এভাবেই জয়ী হবে উষ্ণতা।