ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে

ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মহড়া  | ফাইল ছবি: রয়টার্স

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: গত ৭ অক্টোবর সকালে হামাসের হামলার খবর যখন প্রথম প্রকাশ হয়, ইতাই রুভেনি ও অন্য আপৎকালীন প্যারাট্রুপাররা (ছত্রীসেনা) তাঁদের ব্যাগ গুছিয়ে নেন। সেনাবাহিনী থেকে ডাক পড়ার আগেই জমায়েত স্থানে চলে যান।

কিন্তু প্যারাট্রুপাররা দক্ষিণে গাজা সীমান্তে না গিয়ে উত্তর দিকের সীমান্তে যান। তাঁদের বিশ্বাস, সেখানে হামাসের চেয়ে বড় হুমকি তেহরান-সমর্থিত লেবাননের শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

৪০ বছর বয়সী ইতাই রুভেনি একজন মাস্টার সার্জেন্ট। তিনি বেসামরিক জীবনে সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন উত্তরে না ঘটতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে আমরা এখানে এসেছি।’

ইতাই রুভেনি আরও বলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি, হিজবুল্লাহ (হামাসের চেয়ে) অনেক বেশি আধুনিক। আমরা বুঝতে পারছি, এই সীমান্তে কেবল তিন হাজার যোদ্ধাই আসবেন, এমনটা নয়। এই সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। তা ছাড়া এই সমীকরণে ইরানও থাকবে। তাদের মোকাবিলা করতেই আমরা এখানে এসেছি।’

ইসরায়েলের জন্য হিজবুল্লাহ বড় ধরনের বিপদ—এটা শুধু রুভেনিই দেখছেন না। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য কট্টরপন্থী সদস্য লেবাননের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার্থে নিজেরাই আগে আক্রমণ চালানোর পক্ষে।

এতে বিপদ গুনছে ওয়াশিংটন। তাদের ভয়, সংঘাত আঞ্চলিক রূপ নিলে ইরানও জড়িয়ে পড়তে পারে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন। তবে ইসরায়েলি রাজনীতিক, জেনারেল ও সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস গেঁথেছে যে লেবাননের সঙ্গে নতুন একটি যুদ্ধ অনিবার্য।

নভেম্বরের শেষ দিকে একটি জনমত জরিপ দেখা গেছে, ইসরায়েলের ৫২ শতাংশ মানুষ অবিলম্বে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পক্ষে। অন্যদিকে মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ উত্তরাঞ্চলে নতুন একটি যুদ্ধ শুরুর বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

ইতাই রুভেনি ও রিজার্ভ প্যারাট্রুপাররা ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী লেবানন সীমান্তের ইসরায়েলি শহর রশ হানিকরায় দেখেন, ৭০৫৬ নম্বর প্যারাট্রুপার ব্যাটালিয়ন ইতিমধ্যেই ছোটখাটো সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। গাজাবাসীর সমর্থনে ইসরায়েলি সীমান্তবর্তী শহর ও গ্রামে হিজবুল্লাহ হামলা চালিয়েছে। অপর দিকে ইসরায়েলও পাল্টা কামানের গোলা ও বিমান হামলা চালিয়েছে লেবাননের সীমান্তে।

সম্প্রতি দুই পক্ষের লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও। পাল্টাপাল্টি হামলায় চারজন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। অপর দিকে ১৪ জন লেবাননের নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েলের ড্রোন ও ট্যাংক হামলায় অন্তত তিনজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অরনা মিজরাহি বলেন, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে এবং এই প্রবণতা বাড়তির দিকে। তিনি বর্তমানে তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজে কাজ করছেন।

অরনা মিজরাহি আরও বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সংঘাত বৃদ্ধির এমন প্রবণতা সবচেয়ে দুশ্চিন্তার। কেউই পুরোমাত্রায় যুদ্ধ চায় না, কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা যেকোনো মুহূর্তে এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারি।’

রশ হানিকর শহরের একটি রেডিও টাওয়ার ১৩ বার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত সপ্তাহে ৭০৫৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের ঘাঁটির একটি ভবনের ছাদেও ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে। রশ হানিকরা শহরটি গুহার জন্য বিখ্যাত। তড়িঘড়ি করে বাসিন্দারা চলে যাওয়া একটি গ্রামে ব্যাটালিয়নের ঘাঁটি করা হয়েছে। সংঘাত শুরুর আগে গুহা দেখতে গ্রামটিতে অনেক পর্যটক আসতেন।

হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা ড্রোন হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন টের পেলে গড়পড়তা যেকোনো দিনে কয়েকবার সতর্ক সংকেত বেজে ওঠে। আর ইসরায়েলি সেনারা তাড়াহুড়ো করে আড়ালে চলে যান।

২০০৬ সালে ইসরায়েল-লেবানন দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে গত ১৭ বছর সীমান্তবর্তী এলাকাটি তুলনামূলক শান্তই ছিল। কিন্তু ওই বছরই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী শান্তির গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।

নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী লিতানি নদী থেকে অন্তত ২০ মাইল দূরে সরে যাওয়ার কথা ছিল হিজবুল্লাহর। প্রস্তাবে নিরস্ত্রীকরণের কথাও ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো ইরানের সহায়তায় একটি ভয়ংকর অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে হিজবুল্লাহ। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের কাছে এক লাখের বেশি রকেট আছে। এসব রকেট ইসরায়েলের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন শহরে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে পারে।

গাজায় বোমা হামলা শুরুর পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের অংশ হিসেবে সীমান্তবর্তী ইসরায়েলি গ্রামগুলোতে রকেট হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। পাশাপাশি সীমান্তে ঝটিকা আক্রমণ করতে বিভিন্ন দল পাঠায় তারা।

মিডলইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনবিষয়ক পরিচালক রান্দা সিলিম বলেন, সীমান্তে হিজবুল্লাহর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’ নীতির মতো। এই মুহূর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধের সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করছে। কারণ, হিজবুল্লাহ ও ইরান এই মুহূর্তে কোনো উত্তেজনা চায় না।

ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর উপস্থিতি সহ্য করার মনোভাব নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছে। লেবানন সীমান্তবর্তী ইসরায়েলের মেতুলা শহরের কাউন্সিলপ্রধান ডেভিড আজুলে বলেন, ৭ অক্টোবর ভোরে দুই হাজার মানুষ এটা জেনে ঘুম থেকে উঠেছেন যে তাঁদের সঙ্গেও এমনটা ঘটতে পারত।

মেতুলার অধিকাংশ বাসিন্দাকে গ্যালিলি সাগরের উপকূলবর্তী তিবেরিয়াস শহরের হোটেল ও বিভিন্ন বাড়িতে সরিয়ে নেওয়া হয়।

আজুলে বলেন, এসব মানুষকে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে হলে সীমান্তে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে অন্তত হিজবুল্লাহকে লিতানি নদীর পেছনে সরিয়ে দিতে হবে।

ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল থেকে ৮০ হাজার নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পাশাপাশি গভীর হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দাও। তাই সামরিক সমাধানের বিষয়টি নিয়ে জোর আওয়াজ উঠেছে।

৬ ডিসেম্বর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোর মেয়রদের সঙ্গে বৈঠক করেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি হিজবুল্লাহকে সরে যেতে বাধ্য না করে, তাহলে এটি নিষ্পত্তি করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গানৎসও উত্তরাঞ্চলের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের জন্য গত শুক্রবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্ব যদি হিজবুল্লাহকে সীমান্ত থেকে সরিয়ে না দেয়, তাহলে ইসরায়েল নিজেই দেবে।

এই সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। আরব দেশগুলোর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লেবানন-ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ নিরসনে একটি সমঝোতার প্রস্তাব করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত অ্যামোস হোস্টেইন।

বৈরুতের সরকার সংকটে রয়েছে। এ কারণে চুক্তি করার মতো অবস্থায় নেই তারা, বাস্তবায়ন তো দূরে থাকুক। দেশটিতে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেখানকার ক্ষমতায়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশটির অর্থনীতি ভঙ্গুর।