নিজস্ব প্রতিবেদক: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়ানো হলেও গত প্রায় পাঁচ বছরে মাত্র ৩ হাজার ৬০০ সমাধি সংরক্ষণের কাজ শেষ হয়েছে। আরও ৯০০ সমাধি সংরক্ষণের কাজ চলছে। অথচ এই প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার সমাধি সংরক্ষণের কাজ ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নকশা সংশোধন ও সমাধিস্থল প্রমাণসহ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে এগিয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ ও পরে মারা যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি সংরক্ষণের জন্য ৪৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৮ সালের জুনে (প্রথম পর্যায়) শুরু হয়। তবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ২০১৮ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার ও পর্যায়ক্রমে মোট ৮৬ হাজার ৪০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণ করা হবে।
প্রকল্প শুরুর সময় বলা হয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলের নকশা ধর্মভেদে ভিন্ন হবে। তবে সব সমাধির স্মৃতিফলক বা এপিটাফে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ, খেতাব (যদি থাকে) ইত্যাদির তথ্য উল্লেখ করা হবে। পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণও সেখানে উল্লেখ থাকবে।
বীর শহীদদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার। ২০০৮ সালে দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে এ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। পরের দুটি নির্বাচনেও একই অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে বধ্যভূমি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি সংরক্ষণ করার প্রকল্প হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
নকশায় ঝামেলার কারণে কাজে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও প্রকল্পের পরিচালক মনিরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধির মাপ অনেক বড় থাকায় এবং নকশা সঠিক না থাকায় প্রকল্পটি নিয়ে তেমন এগোতে পারিনি। কাজ এগোতে না পেরে এখন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।’
মনিরুল ইসলাম জানান, সমাধির নকশা ও মাপে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে একেকটি সমাধি সংরক্ষণ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার টাকা। এখন সমাধির নকশা ছোট করায় তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকায়। প্রকল্পটির মোট খরচ ৪৬১ কোটি টাকা থেকে ৩৩২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শেষ করতে না পারায় দুই দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল প্রমাণসহ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। সমাধির স্থান সংকুলান বড় একটি সমস্যা। এ জন্য প্রকল্পের কাজে ধীরগতি দেখা গেছে। এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) যুক্ত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী সমাধি চিহ্নিত করার কাজটি করছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইউএনওদের নিয়ে গঠিত কমিটি। এ ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদেরও মতামত নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা হয়। লালমনিরহাট জেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিফলক ভেঙে পড়া নিয়ে ওই বৈঠকে কথা ওঠে। এ নিয়ে কমিটি ক্ষোভ প্রকাশ করে। প্রকল্পের কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
ওই সময় সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকতে নানাভাবে অবহেলিত হয়েছেন। মৃত্যুর পরও তাঁদের এভাবে অবহেলা করা হচ্ছে। এটা হতে দেওয়া যায় না।’
পরে লালমনিরহাটের ওই ঘটনা তদন্তের সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। সেই সঙ্গে দেশের অন্য কোথাও একই ঘটনা ঘটেছে কি না, তা-ও তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়। গত বছরের নভেম্বরে কমিটির আরেক বৈঠকে সমাধিস্থলের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও নামফলক স্থাপনে ক্রটিগুলো শনাক্ত করে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও সুপারিশ করেছে কমিটি।
প্রকল্পটির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বারবার পরিচালক বদলানোর কারণে প্রকল্পের কাজে ধীরগতি দেখা গেছে। এ ছাড়া জনবলের অভাব রয়েছে। এ কাজে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে ইউএনওদের চিঠি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা সমাধিস্থল শনাক্ত ও নির্মাণকাজ তদারক করেন।