স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল আর শ্রদ্ধার ফুল

স্মৃতিসৌধে পতাকা নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে কিশোর-কিশোরীরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর মিরপুর থেকে আট বছরের ঐশ্বর্য আর আড়াই বছরের ঐশ্বরী সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসেছে মা-বাবার সঙ্গে। দুজনই বাংলাদেশের পতাকা আঁকা পোশাক পরেছে, হাতেও জাতীয় পতাকা। মা-বাবার পরনেও লাল-সবুজের পোশাক। স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পরে ছবি তুলছিল পরিবারটি।

ঐশ্বর্য-ঐশ্বরীর বাবা রামকৃষ্ণ সাধু বলেন, ‘প্রতিবছরই বাচ্চাদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসি। যে কষ্টের মাধ্যমে এই দেশ আমরা পেয়েছি, তা যেন পরবর্তী প্রজন্মও বুঝতে পারে।’

মহান বিজয় দিবসে এই পরিবারের মতো হাজারো মানুষ আজ শনিবার সকাল থেকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসছে। পরাধীনতা ঘোচাতে জাতির যে বীর সন্তানেরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, কৃতজ্ঞ জাতি স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে, নীরবতা পালন করে তাঁদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে।

ভোরের আলোয় স্মৃতিসৌধ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হাতের অস্ত্র ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বিজয়ী বীর বাঙালির সামনে। স্বাক্ষর করেছিল পরাজয়ের সনদে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়ের দিনে আনন্দের পাশাপাশি বেদনাও বাজে বাঙালির বুকে। বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় জাতি স্মরণ করেছে জানা-অজানা সেসব শহীদকে।

সকাল সাড়ে ছয়টায় প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব শুরু হয়। তাঁরা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।

এরপর শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের নেতাদের নিয়ে শহীদবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

হুইলচেয়ারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে ওরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও কূটনীতিকেরা স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করার পর স্মৃতিসৌধ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নামে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমজীবী ও পেশাজীবী সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

মনের শক্তিতে ভর করে প্রতিটি মুহূর্ত পার করা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষেরা এসেছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে। বিজয়ের এই দিনে তাঁদের ছলছল চোখ একদিকে যেমন আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের কথা মনে করিয়ে দেয়, অপর দিকে মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জনের কথা।

সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার ফুল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সকাল ৮টার দিকে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) থেকে হুইলচেয়ারে প্রায় ২০ জন স্মৃতিসৌধে আসেন শ্রদ্ধা জানাতে। শারীরিক প্রতিবন্ধী জাহিদ হাসান হুইলচেয়ারে করে এসেছেন স্মৃতিসৌধে। তাঁর স্ত্রী হুইলচেয়ারটি ঠেলে এনেছেন।

অভিভাবকের কোলে চড়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছে শিশুটি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জাহিদ হাসান বলেন, ‘ভালোবাসার জায়গা থেকে এখানে (স্মৃতিসৌধ) এসেছি। আমরা তো স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখিনি। ইতিহাস ঘেঁটে, ভিডিও ফুটেজ দেখে শহীদদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে, যা অমলিন। যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’

স্মৃতিসৌধে যাঁরা আসছেন, তাঁদের পোশাকে পতাকার রং লাল-সবুজের প্রাধান্য পেয়েছে। বাবা-মায়েরা ছোট ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বিজয়ের উৎসবে অংশ নিতে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার ফুলে ভরে উঠেছে স্মৃতিসৌধের বেদি। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে মুঠোফোনে ছবি তুলতে দেখা যায়।

দুই মেয়ে ঐশ্বর্য আর ঐশ্বরীকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে এসেছেন মা-বাবা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সকাল ৯টার দিকে দীর্ঘ পতাকা নিয়ে গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুরের ইকবাল সিদ্দিকী কলেজের প্রায় চার শতাধিক শিক্ষার্থী স্মৃতিসৌধে আসেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। শিক্ষার্থী আফিয়া জাহিন বলেন, ‘লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। প্রতিবছরই আমরা শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে আসি। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে ভালো লাগছে।’