ট্রেনে ফিরছে। মডেল:জাকিয়া নূর সেবা | প্রতীকী ছবি

আশান উজ জামান: মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ট্রেনে।

পিঁপড়ের সারির মতো লম্বা ছিল ট্রেনটা। ছিল ঘোড়ার সারির মতো দ্রুতগামি। তবে চলছিল সে থেমে থেমে। থামতেই আরো আরো লোকে ভরে যাচ্ছিল বগি। যাত্রীদের হাকডাক আর ভিক্ষুকের হাওকাও মিলেমিশে সে যেন এক ভ্রাম্যমাণ মেছোহাট। কাদা ওঠা পানি ছোটা সেই মাছের বাজারে সাহেব সুবোধের মতো বসে আছি একা বোকা ভদ্দরলোক। অস্বস্তি আর অস্থিরতায় ঘিনঘিন করছে গা। এসি বগিতে এমন হয় না। কিন্তু হুট করেই সেদিন চলে গিয়েছিলাম স্টেশনে। দ্বিগুন দামে টিকিট কিনেও শোভন শ্রেণি। তারউপর যেদিকে চলছে ট্রেন, সিট তার উল্টোদিকে- পিছনপানে চলছি। মাথাব্যথা করছে, বমি বমি লাগছে। পাশের সিটটা ফাকা ছিল, সিগারেট আর ঘামের গন্ধমাখা এক ধাঙড় বেটা দখল নিয়েছে তার। তীব্র কটূ গন্ধ লাগছে নাকে। কপালে তাই চামড়ার ঢেউ তুলে বসে আছি। তখনই দেখেছিলাম তাকে।

ঠাসাঠাসি মানুষকাঁঠালের ফাঁক গলে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মুখটা প্রথমে। বড় বড় দুটো চোখ। তাতে ভিড় ঠেলার বিরক্তি আর সিট না পাওয়ার শঙ্কা। দেখা যাচ্ছিল মেহেদি ফুলের ঘিয়ার উপর শিমুলফুলের লাল ছোপ দেওয়া ওড়না। ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে। তাই টলোমলো পা। দুপাশের সিট ধরে ধরে পড়ে যাওয়া সামলাচ্ছে। নিবিড় মনোযোগে সামলাচ্ছে ওড়নাও। কী যে অপূর্ব সে দৃশ্য! আহা! আমি ভাবছি, এসে যদি সে বসত আমার পাশে! আর বসতেই যদি তার মনে পড়ে যেত গতজন্মের কথা! পড়তেই যদি বুঝতো, সেই যে সে ‘এবার যাই, এরপর যতবার জন্ম নেব, ততবারই তোমার হবো’ বলে চলে গেল তারপর থেকে আমি এখানেই বসে আছি, অপেক্ষায়!

বুঝলো কি না বুঝলো সেটা না বুঝতে পারলেও খুশি হয়ে দেখলাম ও আমার কাছেই এলো। বুঝে শুনে খাই, নিয়মিত দৌড়াই, ফুটবল খেলি, মাঝে মাঝে জিমেও যাই। ফলে পুরোনো শার্টগুলো একটু টাইট লাগলেও কয়েক বছর ধরেই আমি সাতাশ-আটাশ বছরের তরুণ। তেজী তাজা বুক খানিক ফুলিয়ে নিয়ে বসে আছি- মেয়েটা যেন আমার বেস্ট ভার্সনটাই দেখে। অযথা শক্ত করে রাখা মুঠিটা উরুর উপর রেখে কনুইটাকে রাজকীয় হালে বাঁকিয়ে রেখেছি, বসতে গেলে যেন ছোঁয়া লাগে মাসলে। লাগতেই আমি শিউরে উঠব! যে নাম ধরে ডাকলেই ও ছুটে আসত পাগলপ্রায় স্রোত হয়ে, লুটিয়ে পড়ত বুকে, সে নামে ওকে অভ্যর্থনা জানাবো। প্রস্তুতি নিতে নিতে আমি অস্থির। অথচ ভয়ানক স্থির এক ভারি স্বরে আমাকে উঠে যেতে বলল সে!

বসে ছিলাম তিন সিটের একেবারে শেষে, জানলার গায়। ওটা তার, মাঝের সিটটা আমার। টিকিটহীন গন্ধমানবটাও উঠে গেছে ততক্ষণে। তবে বুকে আমার না ওঠার বাহানা। মুখে তাই সংলাপের আহ্বান ।

‘খুব অসুবিধায় আছি। মনে হচ্ছে বমি হবে। কষ্ট করে আপনি যদি আমার সিটে বসতেন...’

‘জানলার পাশে বসা আমারও দরকার। সেজন্যই প্রতিবার উইন্ডোসিটের টিকিট কাটি।’

আহা! কী সুন্দর করে বলা কথা! শব্দগুলোর পায়ে নূপুর জড়ানো যেন, ঝনঝন বাজছে সুর তুলে। যেন সঙ্গীত, যেন গান। গানটা বেশিক্ষণ শোনা হলো না যদিও। মেয়েটার পক্ষে তালহীন হেড়েগলায় হৈ হৈ করে উঠল লোকেরা। অথচ ঠিকই তারা গিলছে মেয়েটাকে। দ্রুত উঠে গিয়ে ওকে বসতে দেওয়া তাই জরুরি। বুঝতে পারছি। কিন্তু বমির ভয়েই মূলত, উঠতে সাহস করছি না। অহেতুক গড়িমসি দেখে সে তখন আমার সিটেই বসে পড়ল। মুখে বিরক্তি স্পষ্ট।

দূরযাত্রায় সঙ্গী এমন আগুনগরম একটা মেয়ে! অথচ আমি অতিচালাক- গোয়ার এক অভদ্রের ভাবমূর্তি ধরে বসে আছি! কী যে দুর্ভাগা মনে হলো নিজেকে। হাহ্! জানলার লোভে এভাবে কেউ দরজা হারায়! সিঁদ কাটার অভ্যাসও নেই, ঘরে এখন ঢুকব কী করে? হতোদ্যম চোখ তাই ফেলে রাখি বাইরে।

তখন দুপুর।

রেললাইনের সুতোয় বোনা গ্রাম আর শহর পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক। পুঁইডাঁটা চুলোয় চড়িয়েছে কেউ, সুবাস লাগল নাকে। পরক্ষণেই মাংশের ঘ্রাণ। পেটে সজাগ হলো খিদে। খিদে ভীষণ চোখেও। বারবার তাকাচ্ছি মেয়েটার দিকে, কিন্তু তার খেয়াল নেই। সে বই পড়ছে। আড় আড় সোজা চোখে তাকিয়ে দেখি আমারই বই! কত আনন্দে যে ভরে উঠলো বুক! ফ্ল্যাপে ছবি দিই না বলে আফসোসও হলো। অবশ্য না দিয়েই ভালো হয়েছে, এত ভালো ভালো বইয়ের লেখক বাস্তবে এমন- জানলে হয়তো হতাশই হতো! হতাশ তখন আমিও। বুকের ভেতর ক্ষোভের হাপর।

যাহোক, খাবার ছিল সাথে, খেয়ে নিলাম।

তারপর ঘুম। ঘুমের ভেতরেই শুনলাম জোরছে একটা ‘টাং’ শব্দ হলো কানের কাছে। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কী যেন একটা এসে লাগলো কপালে। ব্যথার চোটে লাফিয়ে উঠলাম। লোকজন সচকিত হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। সামনের সিটে বসা লোকটার পায়ের কাছে পড়ে থাকা ছোট্ট পাথরের টুকরো দেখেই বোঝা গেল ব্যাপারটা। ট্রেনলাইনে খেলতে থাকা দুষ্ট ছেলেরা ইদানিং প্রায়ই শিরোনামে আসছে এভাবে। ইট পাথর ছুড়ে মারে আগন্তুক ট্রেনে, আর আনন্দে লাফায়। সেই আনন্দের বলী আজ আমি হলাম। পাথরটা জানালায় বাড়ি খেয়েই ভেঙে গেছে, তার ছোট্ট টুকরোগুলো থেকেই একটা এসেছে আমার দিকে, ফলে আঘাত নিতান্তই মামুলি। তবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি এমন, যেন পুরো পাথরটাই ঢুকে গেছে! অব্যবহৃত অভিনয়প্রতিভার সবটুকু ঢেলে দিয়ে যে আয়োজন আমি বাঁধিয়েছি, তাকে হুলস্থূল বললেও কম বলা হয়। অবশ্য পাশে অমন একজনের সহানুভূতি পাওয়ার আশা থাকলে কে-ই বা তা করবে না? তাতে বেশ কাজও হয়েছে; মুহূর্তেই আপন হয়ে উঠেছে মেয়েটা। ব্যাগে বোধহয় সে একটা হাসপাতাল নিয়ে ঘোরে, হেস্কিসল দিয়ে নিবিড় যত্নে মুছে দিল ক্ষতটা। আর কী একটা মলম মাখানো একটুকরো কাপড় দিয়ে বলল চেপে ধরে রাখতে। ডাক্তার এমন হলে আমি বাধ্য রোগীর মতো সবকিছু শুনি। শুনলাম। আর ভাবলাম, আহা, সিনেমা!

সিনেমা শেষ না হতেই পথ শেষ হয়ে গেল। আমরা তখন গন্তব্যে।

ব্যাগ নামাচ্ছি, মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, ‘কই, বমি তো করলেন না! উল্টো নাক ডাকলেন মোষের মতো! ভাগ্যিস পাথরের টুকরোটা এসেছিল, নইলে আপনার ঘুম যে কীভাবে ভাঙতো!’

কী লজ্জা! এই দোষটা আমি কাটাতেই পারছি না। বাসে ট্রেনে চড়লেই ঘুম। আর ঘুমোতেই হুইসেল! সহযাত্রীদের টিপ্পনি শুনে মরে যাই। মরে যেতে যেতেই নামলাম। দেখি সামনেই এগুচ্ছে মেয়েটা। পিছে হাঁটতে হাঁটতে ওকে মাপতে লাগলাম। এত বাহারি ঢেউজাগা দেহ, হলিউড লেগে থাকা আমার চোখও কেমন আটকে আটকে যাচ্ছে! কিন্তু উল্টোপথের লোকেরা আমার চোখে তাকালে তো বুঝে ফেলবে কী দেখছি! মাঝে মাঝে তাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। বিয়ে হয়ে গেছে কি না জিজ্ঞেস করব কি না ভাবছিলাম। আবার ভাবছিলাম বিয়ে হলেই বা কী, যাকে চাই তাকে তো সব অবস্থায়ই চাই! কিন্তু ঐখানে ভিড়ের ভেতর ক্লান্তযাত্রার শেষে চাওয়াটা কি শোভন হবে? অনেক ভেবে ঠিক করলাম, না, এভাবে না। এমন চাওয়া চাইব না বলার সুযোগ যেন না থাকে। তার জন্য তার ঠিকানাটা জানা দরকার, অন্ততপক্ষে মোবাইল নাম্বার। নাম্বারটা চাইবো চাইবো করছি, এমন সময় এক গুমোট মহিলার বেয়াড়া আঁচল মাড়িয়ে ফেলেছি। ফলে কিছুটা ভর্ৎসনা আর পাল্টা কিছু দুঃখ প্রকাশের পর আগুনের দিকে মন দিয়েছি যখন, তখন দেখি ধোঁয়াটুকুও অবশিষ্ট নেই। নেই তো নেই! খুঁজলাম একটু এদিক ওদিক। অপেক্ষা করলাম আরো কিছুক্ষণ। তারপর হাহাকারভরা শূন্য বুকে ছেড়ে গেলাম খালি প্ল্যাটফরম।

তারপর থেকে ওকেই নোঙর করে ভেসে বেড়ানো।

গিয়েছিলাম ফুপুর বাড়ি। কোনো কাজ নেই। আলগা কলার, খোলা বুক। ঘুরব ফিরব, বাতাস লাগাবো গায়।

ফুপাতো ভাই মুকুলের সাথে ক্রিকেট খেলতে নেমে স্বভাবসুলভ বাজে একটা শট খেলে আউট হয়েই দোষ চাপালাম কপালের ক্ষতের উপর। একই ছুঁতোয় ফিল্ডিংও করলাম না। বসে বসে ওদের খেলা আর আকাশ বাতাস মানুষ দেখতে দেখতে বাদাম খেলাম। তারপর গেলাম পুরনো বাসার ভাড়া উঠাতে।

গায়ে গতরে বড় হয়ে উঠেছে শহরটা। জমকের কমতি নেই। পুরনো তল্লাটটাকে তাই ঘিঞ্জিই লাগে। খালুর কাছে শুনেছিলাম- বিহারিরা যখন এদেশে আসে, ওদের জন্য বরাদ্দ ছিল নতুন উপশহর। কিছু বেদখল কিছু বিক্রি- সেখানকার জমিজমা খুইয়ে পরে তারা ছড়িয়ে গেছে, ছিটিয়ে গেছে। তবে বেশিরভাগেরই বাস এই দিকটায়। ভাঙাচোরা গলির দুপাশে ওদের পায়রার খোপ ছোট ছোট ঘর। পড়ে আছে পচতে থাকা খেজুর কাঁদির মতো। কিছু কিছু দালান এদিকেও উঠেছে। তবে অধিকাংশ বাড়িই পুরনো। বেড়ার হোক বা ইটের- সবাই তারা জংধরা থুত্থুড়ে বুড়ো।

ফুপারটাও অমন। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে লম্বা বারান্দায় লেগে থাকা তিনটা ঘর। অথচ একেই আমার প্রাসাদ মনে হতো ছোটবেলায়! দুই ভাই থাকত বাইরের রুমটায়। ওদের সাথেই শুতাম আমি এলে। কত যে গল্প কুরে কুরে খেত তিন বাঁদরের মাথা, আর কত যে গুজব! ঘর ভরে যেত কল্পনা আর খুঁনসুটিতে। সেই একটা একটা ঘরেই এখন একটা একটা পরিবার!

প্রথম ঘরের ভাড়া দিলো সুন্দর একটা মেয়ে। নিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। পরের দরজায় তালা। গাল দিয়ে উঠল মুকুল। ‘শালাদের এই এক স্বভাব। ভাড়া দিয়ার দিন পলায়ে থাকে। এর জন্যি আবার আসা লাগবে এই বস্তিতি।’ কথাটা শেষ হলো তৃতীয় দরজায়। সেটাতেও তালা। দেখেই ও অবাক। ‘এরা তো এমন করে না! কোনো সমস্যা হলো নাকি?’ বাড়ির পেছন দিকটায় খুঁজে এলো। তারপর প্রথম ঘরে নক করল আবার। মেয়েটা বলল সে জানে না। অফিস থেকে এসেছে কিছুক্ষণ হলো, তখন থেকে বন্ধই দরজাটা। কী হলো কী হতে পারে জল্পনা করতে করতে ফিরে যাচ্ছি। গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় মুখ বাড়ালো ট্রেনের ওই মেয়ে!

‘ওহ্ মুকুল ভাইয়া! আসেন, ভেতরে এসে একটু বসেন, দিচ্ছি।’

‘না না, ঠিক আছে, আমরা বরং বাইরেই অপেক্ষা করি।’

দাঁড়িয়ে থাকলাম লাস্য করে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি গাছের ছায়ায়। আবার ওর দেখা পেয়ে ভালো লাগছে। ভেতরে যদিও উদ্বেগ- দেখেও কেন দেখলো না মেয়েটা আমাকে? একটু যেন আহতও হলাম! ভাড়া দিতে এসেই অবশ্য চমকে উঠলো। ‘আরে আপনি! কেমন আছেন এখন? কপালের কী অবস্থা? বমি বমি ভাব কেটেছে?’ খোঁচাটা গায়ে মাখলাম না। একটু হাসলাম। দু’চারটে কথা হলো। বহুদিন ধরে অসুস্থ ওর আব্বু। অবস্থার হঠাৎ অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে নিতে হয়েছে। সেখান থেকেই আসলো। মুকুল বলল, ‘টাকা কডা তালি রাকো, আঙ্কেলের এই অবস্থা। কখন কিরাম লাগে না লাগে।’ কিন্তু রাজি হলো না মেয়েটা। বলল, ‘সমস্যা নেই। ব্যবস্তা সব করা আছে।’ কী টনটনে আত্মমর্যাদা! আর কত সবল মেয়েটা! ভাঙবে তবু মচকাবে না। মুগ্ধ হতেই হলো। বেশি মুগ্ধতায় বুদ্ধি কমে যায়। ফলে নাম্বারটা নেওয়া হলো না তখনও।

আসার পথে বিস্তারিত বলতে হলো মুকুলকে। তারপর শুনলাম মেয়েটার বৃত্তান্ত। নাম মোনতাহা, ও ডাকে মন। বাপ পড়ুটে, ভাই নেই। বোনগুলোর বিবাহিত দুস্থ জীবন। এটা সেটা কেনাবেচা করে মা কিছু আয় করে। মন একটা কিন্ডার গার্টেনে পড়ায়। তা দিয়েই চলে সংসার। সাথে নিজের পড়াশোনা। বহু কষ্টের জীবন। ভালো একটা চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে, পাচ্ছেই না। আজও একটা ভাইবা ছিল। সেখান থেকে আসার পথেই আমার সঙ্গে দেখা। প্রেমে তো পড়েই ছিলাম আগে, ওর গুণকীর্তন শুনতে শুনতে যেন ডুবেই গেলাম আরো। মেয়ে দেখাদেখি চলছে। ওকে দেখলে আব্বু আম্মু নিশ্চয়ই অমত করবে না। কিন্তু আগাতে পারিনি কিছুই। অফিসে জরুরি তলব; সে রাতেই উঠতে হলো ফেরার বাসে। কিছুদূর আসতেই শুনলাম ওর বাবার জন্য রক্ত লাগবে, মুকুল যাচ্ছে দিতে! বড় একটা আপসোসের আঙটায় ঝুলে থাকলো মন আমার! সন্তানের প্রেম ভালোবাসায় তো ভীষণ এলার্জি বাঙালি বাবামায়ের, মেয়েকে হাত করার আগে আমি তাই বাবা-মাকে ইমপ্রেস করার পক্ষপাতি। আহা, আজ যদি আমার রক্তের গ্রুপটা মিলে যেত, মুকুলের জায়গায় যদি আমি থাকতাম!

কিছুদিন পরই শুনি তিনি আর নেই। কারো কেউ মারা গেলে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াটা বোকামি মনে হয় আমার। আমি শুধু পাশে থাকার চেষ্টা করি, কাঁধ পেতে দিই মাথা রেখে কাঁদার জন্য, দূরে থাকলে ফোন করে কান্না শুনি শোকটা যেন হালকা হয়। মনকেও ফোন করলাম, তবে কাঁদল না ও। গলা ধরে ধরে এলো মাঝে মাঝে, তবে সামলে নিল ঠিকই। থেমে থেমে রেখে ঢেকে বলল, যতটা বলার।

তারপর থেকে কথা হয়েছে মাঝে মাঝে। যখন হয়, তখন কিছুদিন খুব ভাবি ওকে নিয়ে। অভ্যাসবশত আবার ভুলেও যাই। বিয়ে করা না করা নিয়ে, পাত্রী পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কথা ওঠে যখন- অফিসে, বাসায়, চায়ের আড্ডায়- তখনই আবার মনে পড়ে ওর কথা। তখন ফোন করি সময় সুযোগ হলে। ওপাশ থেকে খুব একটা আগ্রহ লক্ষ্য করি না বলে এগোয় না কথা।

এরই মধ্যে একদিন মুকুলের ফোন। মেয়েটাকে ও ভালোবাসে [ব্যাপারটা আমি আগেই বুঝেছিলাম, পাত্তা দিইনি। কিন্তু আজ ওর মুখ থেকে শুনতেই মন খারাপ হলো।] ওর মতো করে ও চেষ্টা করেছে নানাভাবে, কিন্তু কাজ হয়নি। আমাকে এখন ঘটকের কাজ করতে হবে। ‘ভাইয়া, তুই তো ভালো গুছাইগাছাই কতা বলতি পারিস, মনরে এটটু বুজোয়ে দ্যাক না কিচু হয় কি না।’

নিজের গায়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছি যে ডাল তাকেই এখন অন্যগাছের কাছে ঠেলতে হবে, ভাবতেই তরল একটা বেদনা ছড়িয়ে পড়ল শিরা উপশিরায়। তবু ফোন করলাম। এটা সেটা বলার পর যখন আমি মূল কথায়, মন গেল ক্ষেপে। স্বর বদলে পরক্ষণেই আবার অনুনয় করল উল্টো। ‘যদি পারেন ভাইয়াকেই একটু বুঝ দেন। আমার ঝামেলার তো শেষ নেই জানেনই। তার উপর উনার পাগলামী একেবারে অতীষ্ট করে দিচ্ছে!’

‘পাগলটা খুব পাগল আমি জানি। খুব পছন্দও করে আপনাকে।’

‘পছন্দ তো সে আমাদের পাশের বাসার মেয়েটাকেও করে!’

‘কী বলছেন! ওর কথা শুনে তো...’

‘বোঝা যায় না। আমি জানি। তবে মেয়েটা ভালো। ওদের মানায়ও ভালো। তা না হলেও এ ধরণের সম্পর্কে যাওয়া সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে।’

তবু আমি যুক্তি দিচ্ছি যখন [মুকুলের জন্য না, ওর কথার দড়ি ফেলে আমি মূলত পানি মাপছি আমার জন্যই], মন জানালো আরেক ঘাটে বাধা পড়েছে নোঙরটা তার। ছোট বেলা থেকেই এক ভাইয়া ওকে পড়িয়েছে, বিনে পয়সায় বিনে প্রশ্নে; ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, তবে ছেলেটাকে ওর দুর্বলই মনে হয়; যদি সে ওকে চায় কোনোদিন, না করে তাকে কষ্ট দিতে পারবে না। এ কেমন কথা! অদ্ভূত লাগল ব্যাপারটা আমার কাছে। এ তো ভালোবাসা না, কৃতজ্ঞতা। মনও সেটা জানে, তবু তার ও-ই সিদ্ধান্ত! আমি তাই কথা বাড়াই না আর। মুকুলকে বোঝানোর চেষ্টা করি, বোঝে না। এটা করবে সেটা করবে নানা রকম পাগলামীর কথা বলে। এসব কথা বলার ছুঁতোয় আমি প্রায়ই ফোন দিই মনকে। দিনে দিনে মনও যেন সহজ হয়ে উঠছে আমার প্রতি। তবে নিজের কথা ও বলেই না খুব একটা। কথা হলেই আমার খোঁজখবর, চাকরি কেমন লেখালেখি কেমন এটা সেটা। ভাব ভালোবাসার লাইনে দুই একটা শব্দ উঠলেই ও স্তব্ধতার ধামা দিয়ে চাপা দিয়ে দেয় তা। তারপর ব্যস্ততার ভাণ করে ফোন রাখে। এমনিতেই আমার মৌমাছি মন, ঘুরিয়া বেড়ায় এ ফুল সে ফুল, তারউপর এমন অনাদর, কতদিন আর ভালো লাগে। যোগাযোগ তাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

এর মধ্যে পদোন্নতি হলো, দায়িত্ব বাড়ল। নতুন ভবনে অফিস নিতে গিয়ে ঝামেলাও হলো কিছুদিন। তারপর তো দেশেই ছিলাম না মাস চারেক। ফলে তারটা কেটে গেছে। ফিরে এসে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। বড় বড় দুটো ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কাজ শেষ করলাম। ওর কথা আর মনে ছিল না।

মনে পড়ল এই সেদিন আবার।

দারুণ একটা এসাইনমেন্ট পেয়েছি।

নন-বেঙ্গলিদের নিয়ে ধারাবাহিক একটা রিপোর্ট ছাপা হবে। তুলে আনা হবে এদেশে তাদের আগমন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা, স্বাধীন বাংলায় বসবাস, আর বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট। আমায় লিখতে হবে বিহারিদের নিয়ে। পড়াশোনা কিছু করেছি, করছি, আরো করব। কয়েকজনের সাক্ষাৎকারও নিতে হবে। দোকানে বাজারে বাঙালি-বিহারি বিহারি-বিহারি আলাপ পর্যবেক্ষণ করেও চেষ্টা করব সামগ্রীক ছবিটা ধরতে। ঢাকা সৈয়দপুর যশোর রংপুর আর কুষ্টিয়া- বিহারিদের বাস মূলত এই শহরগুলোতেই বেশি। স্বভাবতই আমি যাচ্ছি ফুপুরটায়। উঠব ফুপুর বাসায়ই, অফিস জানবে হোটেলবাস। আসার আগে একটা খালি ভাউচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বেশ কিছু উপরি তাতে আপছে ঢুকে যাবে পকেটে। আর এই সুযোগে মন-সংযোগেরও যদি উপায় হয় কোনো! সব মিলে জমাট সফর- কলাও বেচবো, রথও দেখবো ইচ্ছেমতো!

শোভন শ্রেণির টিকিট কেটেছি। গতবারের মতো যদি রথের দেখা ট্রেনেই একবার পাই! কিন্তু বেলতলার দুঃখ তো জানিই, ন্যাড়ারা বারবার আসে না! আসবে না জেনেও আছি ওরই অপেক্ষায়।

কপালে বোধহয় আমি ‘খালিহাতে কাওকে ফেরাবো না’ লিখে নিয়ে ঘুরি। নইলে আমার কাছেই কেন ছুটে আসবে ভিক্ষুকেরা সব? কেন কিছু না দেওয়া পর্যন্ত নড়বে না? আজও তাদের সেই অবস্থা। হাত বাড়িয়েই ভাস্কর্য হয়ে যাচ্ছে। আমি মাথা নাড়ছি, ‘আজ মাফ করো’ বোঝাতে চাচ্ছি, পারছি না। শেষে যাকে যতটুকু পারছি, দিয়ে বিদায় করছি। এর মধ্যে কত পুকুরে যে স্নান করলাম জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে! কত ডোবায় ডুবে কত রঙের ডাঙায় যে উঠে এলাম! ভাবতেও ভালো লাগে। গ্রামগুলোর পাশ ঘিরে বয়ে গেছে ধানখেতনদী। নদীর বুকে ফাগুন বাতাস। আমগাছেরা মুকুলে মূখর। শিমুলের বোধহয় বিয়ে, ফুল-টোপরে তার মাথা লালে লাল! তাতে ঢেউ তুলে বয়ে যাচ্ছে ট্রেন। তারচেয়েও দ্রুত বয়ে যাচ্ছে মন আমার, ছুটে যাচ্ছে মোনতাহার দরজায়। যেমন দেখে এসেছিলাম, তেমন কি আর পাবো এবার? তারচে’ বড় কথা, পাবো তো? ভালো কোনো চাকরি কিংবা বিয়ে তাকে অন্য ঘাটে নিয়ে গেল কি না তা-ই বা কে জানে।

জানার জন্য অবশ্য দেরি করতে হলো না। ফুপুর বাসার দরজা খুলতেই দেখা গেল ওকে! সর্বনাশ! ও এখানে কেন ও? আমাকে পাশ কাটিয়ে ওরা কি বিয়ে করে ফেলেছে? যাকে ভালোবাসি এত, সে এখন ছোটভাইয়ের বউ! ভাবতেই কেমন দুমড়ে গেল ভেতর আমার, মুচড়ে গেল বাইর। তবে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না ফুপুকে। কদমবুচি করতে গিয়ে সামলে নিলাম। তারপরই ‘খালাম্মা, আমি তাইলে আসি এখন’ বলে আমাকে সৌজন্য-নিমন্ত্রণ জানিয়ে বেরিয়ে গেল মনপাখিটা। খালাম্মা! আহা! মণ খানেকের একটা পাথরই যেন সরে গেল বুক থেকে! স্বস্তিমধুর হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে এলো নতুন আশার সুরভী। আবার পণ করলাম, বিয়ে করলে একেই করব। কী স্নিগ্ধ একটা মেয়ে! সেই আগের মতোই গুছিয়ে কাপড় পরা, পরিপাটি সাজ। মুখটাই যা একটু মলিন, একটু যেন চিন্তিতও মনে হলো।

ফুপুকেও চিন্তিত দেখলাম। কুশল বিনিময় শেষে আমাদের আলাপ যখন এদেশ সেদেশ ঘুরছে, ভেতর থেকে তখন আরেকটা মেয়ে এগিয়ে এলো। করুণ একটা শাড়ি পরা, চোখমুখও মলিন। শরীরটা কেমন ভার ভার। ফুপু পরিচয় দিলেন, আফিয়া, মুকুলের বউ। আহা, কী সুখের কথা, মুকুল এখন আর আমার প্রতিদ্বন্দী না! যাহোক, মেয়েটাকে আমি চিনি, এর কথাই বলেছিল মন। দুই একটা কথা শেষে সে চলে যেতেই ফুপু হয়ে উঠলেন পাঁড় শাশুড়ি।  

‘আর বলিসনে, আমাদের এক ভাড়াটিয়ার মেয়ে। খুব বিপদে পড়ে গিছিল। গিয়ে মুকুল উদ্ধারই করেছ, বলতি পারিস। বাপমরা মেয়ে, তার উপর বিহারি। তা মেধাবী দেখে আর আপত্তি করিনি।’

মেয়েটা বিহারি! কথা শুনে বুঝতেও পারিনি আমি! অদ্ভূত তো! অদ্ভূত লাগলো ফুপুর সরল চেহারাও। বড়ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার আগে তো হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছিল। মেয়ে হতে হবে বড়ঘরের, সুন্দরী মেধাবী, যার মামাবাড়ি সম্ভ্রান্ত। মামাবাড়ি অভিজাত মানে মেয়ের মাও অভিজাত। আর মা ভালো মানে মেয়েও ভালো। আরো কত সূত্র, কত শর্ত! আর ছোটটার বেলায় এত সহজে এমন একটা মেয়ে ঘরে তুলে নিল। নিশ্চয়ই কিছু ব্যাপার আছে।

ব্যাপারটা খোলাসা করল বড়ভাই। সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। সেটা গড়িয়েও গিয়েছিল বেশ। এক বিকেলে ওরা যখন ঘরে, পাড়ার লোকেরা জোর করে ধরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।

তবে মুকুলের ভাষ্যটা অন্য রকম।

‘রিস্ক নোবো না বলেই এরাম করিছি ভাইয়া। বন্ধুদের সব বলাই ছিল আগে। ভাড়া নিতি যাব যখন, লোকজন নিয়ে ওরাই আমাদের বিয়ে পড়ায়ে দেবে। আর আম্মুকে বলবে ধরা খেয়ে বিয়ে করিছি। নইলে তুমি তো চেনোই তাকে, সম্পর্কটা কোনোদিনই কি মেনে নিত?’

‘আমি এমন কিছু করলে আব্বুও মানতো না। তবু..’

‘তবু টবু কিছু নেই, ভাইয়া। চালাকী করতি গিয়ে কী ঠকা যে ঠকিছি!’

‘ঠকিছিস মানে? বৌমা তো আমাদেরই মতো, দেখতেও সুন্দর। মেধাবী, চাকরি করে। আর তুই? আয়নায় একবার ভূঁড়িসমেত দ্যাখ নিজেকে, সনদের ওজন নে, তারপর বুঝবি যে তোর লাভই হয়েছে।’

‘আর লাভ!’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বড় করে। ওদিকে তাই আর এগোলাম না আমি। কথায় কথায় মনের কথা উঠলো। উঠতেই গেল ক্ষেপে। ‘আর বোলো না, এত দেমাগ! ও রাজি হলি কত সুকি হতাম আমি, ভেবে দ্যাকো!’ যার একে এ হয় না, দশেও কি তার হয়? কিছু না বলে তাই শুনেই গেলাম আবোল তাবোল কথা ওর। তার মধ্যেই জানা হলো মনের এবাড়ি আসার কারণ। বাবা মারা যাবার পর থেকেই পড়ুটে হয়ে পড়েছে মা। হাসপাতালে থাকতে হয়েছে কিছুদিন। খরচ টেনে পারছে না। ফুপুর বাসাটা ছেড়ে চলে গেছে আরো সস্তা একটা বাসায়। চিকিৎসা খরচ বাকি পড়েছে, শোধ দেওয়ার জন্যই এসেছিল কিছু ধারের আশায়।

কী সংগ্রাম করেই না কাটছে মেয়েটার জীবন।

সংগ্রাম মনে হলো আফিয়াকেও কম করতে হচ্ছে না।

কাজেকর্মে ভীষণ চটপটে সে। বাবু পেটে, তবু বসে নেই। অফিস থেকে ফিরেই লেগে পড়ছে কাজে। এটা সেটা গুছাতেই আছে। ওদিকে মুকুল বেকার। খরচও বাড়ছে। বাড়িভাড়া আর বৌয়ের বেতনই সম্বল ফুপুর। তবু দেখলাম বউমাকে নিতে পারছে না সে। ‘আর বলিসনে। দুঃখে কষ্টে মরছিল, ছুড়াডা তো হাতেম তাই। নিজের পেট চলে না, বিয়ে করেছে। একন বোজচে ঠ্যালা। না মেলে সমাজধর্ম, না মেলে খাওয়া। কী যে বিপদ! ’

‘প্রথম প্রথম এ্যাডজাস্ট করতি সবারই সমস্যা হয়। তোমারও হইলো!’

‘পাকা পাকা কথা বলিসনে খোকন! ঘরসংসারের তুই কি বুজিস?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে, ‘তবে সমস্যাডা আসলে ওর না, ওর জাতের। সেজন্যিই মিশতি পারচে না, বুজলি?

‘কথায় কথায় জাত তোলা ঠিক না, ফুপু।’

‘তা না তো কী? হ্যায় ঠিক, সমস্যা আমারও হইলো। সে সব আবার আমিই ঠিক করে নিইলাম। তার জন্যি তো ওর মতো মারে নিয়ে রাকিনি কাচে।’

‘আচ্ছা! সমস্যা তালি মাঐকে নিয়েই!’

‘না, তা না। অসুস্ত মানুষ, মেয়ের কাছে আচিস। তা বাপু থাক, খা দা। না, সবকিছুতিই খবরদারি তার। দুজনার গুজুর গুজুর ফাসুর ফুসুর শেষই হয় না। যাউঙ্গি খাউঙ্গি করতিই থাকে সারাক্ষণ। লোকজনের সামনে মান থাকে বল? ওই নিয়ে দু’চারডে কতা বলিলাম একদিন, সেই থেকে ঢং করে আছে। কথা কবে না।’

ফুপুর দু’চারটে কথা মানে কী, তা আমি কিছুটা বুঝি। আরো একটু জানালো মুকুল।

মাস দুই আগের ঘটনা। ফুপাতো বোন মিনুকে দেখতে এসেছে। প্রেমের বিয়ে। ও বলেছিল, সব আলোচনা ওরা করেই রেখেছে। আসতে হয় বলেই আসবে ছেলের বাপচাচা। দেখবে, দিন ঠিক করবে চলে যাবে। কিন্তু ঘটছে সব উল্টো। তাদের খাই যেন মিটছেই না, একের পর এক দাবি উঠাচ্ছে। বেলাজ দর কষাকষি শুনে মুখ খুলেছেন মাঐ। গালভরে ধুয়ে দিয়েছেন ইচ্ছেমতো। এই জামানায় কেউ কি এখন আর যৌতুক নেয়? তার মেয়েও তো এই ঘরের বউ, কই তার বিয়েতে তো তাকে একটা টাকাও যৌতুক দিতে হয়নি! তাছাড়া এমন যোগ্য একটা শিক্ষিত মেয়েকে নিতে এত তাল বাহানা কেন? এত লোভী এত অবিবেচক কেন তারা?

খাঁটি বিহারি উচ্চারণে সেই বাঙলা শুনেই হোক, বা কথার ঝাঁঝে, রাগ দেখিয়ে চলে গেল ছেলেপক্ষ। আর তড়পাতে লাগল মিনু। এতদিনের সম্পর্ক ভেঙে গেল, কিছু যদি করে বসে সে! এই মেয়েকে এখন কীভাবে সামলাবে ফুপু? স্বভাবতই সব ঝাল তখন মাঐয়ের উপর পড়েছে।

‘তা রাগের মাতায় না হয় এটটু আধটু বকিছি, তাই বলে কথা বন্ধ করে দেবে?’ বলতে বলতে কান্না জুড়ে দিল। ‘তোর জামাই তো গায় বাতাস লাগায়ে ঘুরে বেড়ায়, জ¦ালা হয়েছ সব আমার। আর কত সহ্য হয়, বল? সব দোষ এই কপালের, নাই এরাম বউ জোটপে ক্যান! বড়ডা এক রাজরাণি, লাটসাহেবের বেটি। বরকে রেখেছে আঁচলের নিচে। বাড়ি আসলি পানি ঢেলেও খায় না। ছোটটা সে তুলনায় লক্ষী। কিন্তু মা ভাই বোনই তার সব, তাদের চিন্তায় তটস্থ সারাদিন। সাথে বরটা পেলেই চলে, আমরা যেন কিছুই না।’

আমি তো তাহলে আরো দূরের। তবু কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমার ওকে বোঝানো উচিৎ। গর্ভাবস্থায় কি যন্ত্রণার  শেষ থাকে নারীর? এর মধ্যে আবার ত্যাড়ামি কেন? ফুপুকে কিছু করতে দিচ্ছে না। একা একা বমি করা একা ধোয়া মোছা। অনেকের শুনেছি ওঠা বসা করতেও সমস্যা হয়। আছে অসুস্থ্য মায়ের দেখাশোনাও। এতকিছু কোন সাহসে করছে পাগলিটা? ক্ষতি যদি কিছু হয় এতে, তারই তো হবে। তাছাড়া রিপোর্টের জন্যও দুই একটা প্রশ্ন করার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সুযোগই পাচ্ছি না।  

এর মধ্যে একবার মনের বাসায় গিয়েছি। বস্তি এলাকায় ঘর। রাস্তা থেকে নেমে দুনিয়ার নোংরা পার হয়ে ঢুকতে হলো ঘরে। ঢুকেই অবশ্য বদলে গেল ছবি। ঘরটা সুন্দর গোছানো, সাজানো। মন আসলেই পরিপাটি খুব। আন্টির অবস্থা খুব ভালো না। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে, কিছুদিন হলো জন্ডিসও। আজকে আবার প্রেসার বেড়েছে, ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ফলে তার সাথে কথা হলো না। তবে মনের আচরণ খুব আপন মানুষের মতো। সহজ স্বরেই বলে যেতে লাগলো সব। আম্মুর অসুস্থতা, চাকরিবাকরি, বিয়েশাদি- বাদ গেল না কিছুই। সেই ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। এমন কিছু হবে, তা তো জানতামই। তবু, শুনতেই যেন নীল একটা ধূসর ব্যথা এসে চিড়িক মারল বুকে। আক্ষেপের বান ডাকলো। অবশ্য যুক্তির সিমেন্ট বালিতে লোকভয়ের ইট দিয়ে বাধ দিয়ে রেখেছি শুরু থেকেই। সেই কংক্রিট ছুঁয়েই অভিনন্দন জানালাম। জিজ্ঞেস করলাম, মায়ের কী হবে? ‘সঙ্গে নিয়ে যাব। আম্মু যে থাকবে আমার সাথে, তা ও বাসার সবাইকে বলেই নিয়েছি।’ শুনেই আফিয়ার ছবিটা ভেসে উঠল চোখে। তবে কিছু আর বললাম না এ ব্যাপারে।

আন্টির রিপোর্টগুলো দেখতে চাইলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো মন আমার দিকে। স্বাভাবিক, সাংবাদিকের কাছে রিপোর্ট বলতে প্রতিবেদন, ডাক্তারি রিপোর্টের কী বুঝব আমি! বুঝব যে না, সে তো আমিও বুঝি। সব ক’টার ছবি তুলে তাই শুভ্রকে পাঠিয়ে দিলাম মেসেঞ্জারে। সমস্যাগুলোও শুনে শুনে লিখে জানালাম। এখন দেখা যাক ও কী বলে।

একটু নাশতা দিয়েছিল, খেলাম। মন দুঃখ করল খুব। ‘কী কষ্ট করে যে আব্বু-আম্মু আমাদের বড় করেছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। তারপর যখনই একটু সুখের মুখ দেখলাম, তখনই অসুস্থ হয়ে পড়ল তারা! আব্বু তো গেলোই, এখন আম্মুকে রাখাও দায়। জীবন এমন কেন, বলুন তো!’

সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, তাই বিদায় নিলাম। নিয়ে রাস্তায় উঠেছি কি উঠিনি, তখন শুভ্রর ফোন। বলল, ‘রোগীর লিভার বলতে কিছু তো আর বাকি নেই!’ আমি কোমরের অবস্থা জানতে চাইতেই ও গেল ক্ষেপে। ‘তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না কোনোদিন? ভাঙা কোমর নিয়েও মানুষ বাঁচে, কিন্তু তার লিভারের যে অবস্থা তাতে বাঁচানো মুশকিল। ভালো ডাক্তার দেখাতে বল।’ কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম কী করা যায়। তারপর শুভ্রর লাল নীল কথাগুলোকে আমি হলুদ করে বললাম মনকে। খালাম্মার অবস্থা খুব খারাপ। আমার বন্ধু বলেছে পারলে আজই উনাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে। ওখানে ওর পরিচিত ভালো ডাক্তার আছে দেখিয়ে দেবে। সংগে আরো কিছু এটা এবং সেটা। স্বভাবতই ঘাবড়ে গেল মন। ঘাবড়ানোরই কথা। মায়ের সুস্থতার প্রশ্ন, আবার এত টাকার ফ্যারা। দেখলাম, ইতস্তত করছে। বললাম, ‘খরচ নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’

‘না না, আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমিই ব্যবস্থা করব।’

‘আগে তো চিকিৎসা হোক, তারপর দেখা যাবে।’

অনুমতির জন্য মন তখন ফোন করল হবু বরকে। আর আমার জ্বলে গেল গা! পরক্ষণেই অবশ্য টগবগিয়ে উঠলাম। বিয়ে কেবল ঠিক হয়েছে, হয়ে তো যায়নি! এখনো সুযোগ আছে তরী ভেড়ানোর। তার আগে মেয়ে ও মাকে পটাতে হবে আচ্ছামতো। তার জন্য এ-ই তো সুযোগ আমার!

ঠিক হলো ফেরার ট্রেনেই নিয়ে যাব ওদের। কিন্তু টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই অবশ্য ব্যবস্থা হয়ে গেল! হা হা, জাদু!

আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিকে নিয়ে চষে বেড়িয়েছি বিহারিপাড়া। রিপোর্টের কাজ মোটামুটি গোছানো শেষ। লিখতে থাকা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটা উপন্যাসের জন্যও কিছু তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছি। আরো দুই একদিন থাকতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সুযোগ নেই।

রাতের ট্রেনে ফিরব। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে দেখি ফুপুরা বাসায় নেই। আফিয়া আর মাঐ একা। গুছিয়ে নিয়ে খেতে বসলাম। ভাবলাম একটু বুঝিয়ে দেখি মেয়েটাকে। ‘বর শাশুড়ির উপর রাগ করে থাকা ঠিক না, হাজার হলেও তারাই এখন আপন।’ শুনেই খই ফুটালো সে। কিছু তার অভিমান, কিছু অভিযোগ। নাচার এক বিচারক হয়ে শুনতে লাগলাম।

‘আম্মুকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল এরা, জানেন?’

‘কী বলছেন?’

‘হ্যাঁ। বাবাকে হারাইছি ছোটবেলায়। সেই থেকে আম্মু-ই যুদ্ধ করে বাঁচাই রেখেছ আমাদের। ভাইবোনর সব বড় নিজের পথ দেখেছ। আম্মু এই বয়সে একা থাকবে কীভাবে? তাই নিয়ে আসিছি। দু বেলা দু মুঠো খায় শুধু। আর নিজের মতো পড়ে থাকে চুপচাপ। দোষ বলতি ওই নিজির ভাষায় কথা বলা। সেটাই সহ্য হয় না কারো। পড়শিরা আমাদের জাত জানলে নাকি জাত যাবে আপনার ফুপুর। মাঝে মাঝে তাই বের হই যখন, পার্কে টার্কে যাই, বা বেড়াতে, আম্মুকে নিই না। বাইরের লোকের সামনে তার বোরোনোও বারণ। কিন্তু ওইদিন যে কী থেকে কী হলো!’

কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর। ওপাশে টিভি চলছে, তার শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।

‘ছোট থেকেই এ জ্বালায় জ্বলছি, এতে তাই অভ্যস্ত আমি। কিন্তু বিয়ের পর থেকে জ্বলুনিটা যেন অসহ্য মাত্রায় বেড়েছে। হুটহাট দুই একটা বিহারি শব্দ বেরিয়ে গেলেই মরণ। এমনভাবে শাসায়, যেন পারলে আমায় বের করে দিত! এমনভাবে তাকায়, যেন মানুষ না আমি, ঘৃণ্য কোনো জন্তু। বিশ্বাসই হয় না আমাদের প্রেমের বিয়ে। বাঁচতে ইচ্ছা করে না, জানেন! আম্মুও সুযোগ পেলেই বেরোয়ে যায়। ধরে বেঁধে তাকে নিয়ে আসাও আর এক নাটক। তার ঘরে তাই তালা দিয়ে রাখি। আর কথা বলতে না পেরে যে কষ্ট সে পায়, তার ভাগ নেওয়ার চেষ্টা করি।’

শুনতে শুনতে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে আমার। হঠাৎ কেন যেন প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা, মোনতাহাও কি আফিয়াদের মতো? অবশ্য, তা হলেই বা কী, না হলেই বা কী? কিন্তু এত যে আয়োজন করছি, মোম যদি আমার জন্যই গলে, আর যদি জানা যায় ওরা বিহারি, তখন?

সে যখন হবে তখন দেখা যাবে।

আফিয়াকে তো কিছু বলা দরকার। কী বলব? খুঁজে পাচ্ছি না। যতই কথা না থাক, মানুষ কথা বলেই। সেভাবেই বললাম, ‘রাগের মাথায় কতকিছুই তো বলে লোকে। তা ধরে রাখা নিজের জন্যই ক্ষতিকর।’ পর্দায় তখন দিদি নাম্বার ওয়ান। তারকা মেয়ে আর তাদের মায়েরা অতিথি। হাস্যকর সব খেলা চলছে, মাঝে মাঝে কথাবার্তা। এক একজন তার মায়ের ত্যাগ আর সংগ্রামের কথা বলছে, বোকামির কথা বলছে, গর্বের কথা বলছে। এই সবাই গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে, তো পরক্ষণেই গ’লে পড়ছে কান্নায়। সেদিকে তাকিয়ে আছি। খেয়াল করলাম, মাথা নিচু করে আছে মেয়েটা। কেঁপে কেঁপে উঠছে, যেন বোবা সেলফোন।

কিছুক্ষণপর ফুপুরা ফিরল।

স্বাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। বৌমার জন্য চমৎকার একটা শাড়ি এসেছে। পরার পর সেটা আরো সুন্দর লাগল। তবে ওর মুখের আকাশ কালো ধোয়ায় ঢাকা।

বেরিয়ে দেখলাম আকাশেও মেঘ। আমার আগেই পৌঁছে গেছে মনেরা মা-মেয়ে। বসে আছে নারীদের বিশ্রামকক্ষে। তখনও তাই কথা হলো না আন্টির সাথে। কদিন খুব খাটনি গেছে, এত ছোটাছুটি এত ব্যস্ততা, বসলেই ক্লান্তিতে ঢুলে পড়ছিলাম। মশার কামড় আর অন্যলোকের বিড়ির ধোঁয়া খেয়ে আমি তাই হেঁটে মরলাম বাইরে।

ট্রেন আসলো কয়েক ঘণ্টা দেরিতে। আসতেই হামলে পড়ল মানুষ। গেটে এত ভিড়, আমাদের গেট দিয়ে ওঠা গেল না। অন্য বগিতে উঠে বহুকষ্টে নিজেদের সিটে যখন পৌছলাম ততক্ষণে ঘণ্টা পার। বসতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। রসুনের খোসার মতো পাতলা একটু তন্দ্রা লেগেছে কি লাগেনি, হঠাৎ ভীষণ ঝাঁকি দিয়ে উঠল ট্রেনটা। তার সাথে বিকট বিকট শব্দ। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়লে বা বুলডোজার দিয়ে দালান গুঁড়িয়ে দিলে যেমন শব্দ হয়, ঠিক যেন সে রকম। কিছু খেয়াল করে ওঠার আগেই যাত্রীরা এদিক-সেদিক ছিটকে গেল। মনকে বললাম খালাম্মাকে শক্ত করে ধরে রাখতে। আমি ধরে রাখলাম সামনের সিট। তবু ধাক্কার পর ধাক্কা খেলাম পাশের জনের সাথে। কিছুক্ষণ এরপর দুলতেই থাকলো বগিটা। দুলতে দুলতে হঠাৎ গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো উল্টে গেল। উল্টো হয়েই সেটা নামতে লাগলো সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো; যেন নিচ থেকে কোনো দৈত্য বগিটাকে টানছে অবিরাম। আমি দেখছি সব, কিন্তু বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। নিচে আছড়ে পড়লাম যখন, এত জোরে পড়লাম আর এত ধাক্কা খেলাম, মনে হলো মরেই যাচ্ছি।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। হুঁশ যখন হলো আবার, দেখি আমি পড়ে আছি আমারই রক্তে ভেজা মাটিতে। এপাশে ওপাশে আলো। হৈ চৈ হাকডাক আহাজারিতে কান রাখা দায়। নদীতে পানি নেই; ধাক্কাটা বোধহয় সে কারণেই বেশি লেগেছে। দুমড়ে মুচড়ে উল্টে পড়ে আছে বগিগুলো, মস্ত এক এ্যানাকোন্ডার মতো পড়ে আছে মুখ থুবড়ে।

আহত নিহত যাত্রীদের টেনে বের করছে যারা, দেখে তাদের গ্রামবাসীই মনে হলো। চারপাশে সারি সারি মানুষ। হাত-পা ভাঙা কারো, কারো হাত-পা ছেঁড়া। জমাট রক্তের লেই চেয়ে আছে অধিকাংশেরই শরীরের পাশ ঘিরে। ডান উরুতে বেশ বড় একটা গর্ত আমার, হাতে ভীষণ ব্যথা। তবু, ভালো লাগল যে বেঁচে আছি। কাছেই একটা মেয়ের আর্তনাদে কেঁপে উঠতেই খেয়াল হলো মনেরাও ছিল সঙ্গে। ওদের কী অবস্থা? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সাজানো মানুষগুলোর উপর চোখ বুলাতে থাকলাম। আন্টির বোরকা বা মনের থ্রিপিছ যেকোনোটা চোখে পড়লেই চিনব। কিন্তু পাচ্ছি না। তাহলে কি ওরা বগিতেই থেকে গেছে? নাকি আগেই উদ্ধার করে নিয়ে গেছে ওদের? যা-ই হোক, যেন ভালো থাকে ওরা, বড় কোনো বিপদ যেন না। হলে আমি কী করে বুঝ দেব নিজেকে? আমার চালাকিতেই তো ট্রেনে উঠেছিল ওরা! ভাবতেই দেখি পড়ি মরি ছুটে আসছেন আন্টি। গায়ের কাপড় ভেজা, আলুথালু, ওড়না নেই। ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না। তবু খুশি লাগলো, আছেন তো! পা টেনে টেনে আমিও খানিক এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি হতেই তিনি হাত ধরলেন আমার।

‘তুমিও এটটু দ্যাকো না বাবা, আমার মেয়ের মাথাডা খুঁজে পাচ্চিনে কোন্টুই।’

শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। কোনো অনুভূতিই যেন নেই, কিছু চিন্তাও করতে পারছি না। পাঁজরের গোড়ায় কে যেন গরম পানি ঢেলে দিয়েছে, তেমন জ্বলুনি। অথচ শরীর জমে বরফ।

কিছুক্ষণ পর চমক কাটলো আন্টির আরেক ডাকে। তাকিয়ে দেখি পাথর হয়ে আছে তার মুখ। শোকের কোনো চিহ্ন নেই, জমে আছে থমথমে গাঢ় এক রাত।

আহারে, মন আমার! কী করতে চেয়ে কী করে ফেললাম! শোকেই হোক, বা পায়ের ক্ষতটার জেরে টলে টলে যাচ্ছে পা। আমি যেন পুঁতে যাচ্ছি মাটিতে, আবার যেন যাচ্ছিও না। মনে হচ্ছে টলে পড়ে যাব, কিন্তু পড়ছিও না; খালাম্মাই ধরে রেখেছেন শক্ত করে।

কী ধরে রেখেছেন তিনি? অপরাধীর হাত? না কি অবলম্বন?