মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। ঢাকা, ১০ নভেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের রাজনীতিতে প্রচণ্ড নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ব্যক্তি, দল, ক্ষমতা ও রাজনীতির স্বার্থে এবং একটি চেয়ারের দিকে তাকিয়ে মানুষকে দেশাত্মবোধের বিষয়গুলো ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সব মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছিল। সেটি কতটা মনে রাখা গেছে? এই ভুলে যাওয়ার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।

শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় ‘লারমা তোমায় লাল সালাম’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সুলতানা কামাল। এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটি। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়িতে নির্মমভাবে নিহত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন, ’৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ক্ষেত্রে সব মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এমন একটি বাংলাদেশ হবে, যেখানে সবাই তার নিজ নিজ পরিচয়ে, মাথা উঁচু করে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করবে। কিন্তু কথায় ও কাজে এত তফাত হয়ে গেল কীভাবে?

দেশের রাজনীতিতে প্রচণ্ড নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে সুলতানা কামাল বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রবোধের এত অভাব, মানুষের অধিকারবোধের এত অভাব, নিজেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা, নিজের অধিকারহীনতা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাওয়া। সবকিছুর পেছনে সেই বিস্মরণ। আমরা মানুষকে ভুলে গেছি। সব মানুষের অস্তিত্বকে গ্রহণ করতে পারিনি।’

সমাজে অনুসরণ করার মতো মানুষের ভীষণ দুর্ভিক্ষ চলছে জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা জানি না কাকে অনুসরণ করতে পারি? আমার সন্তানকে কোন নামটা নিয়ে বলতে পারি, এর মতো তুমি হও। এই দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ঢাকা, ১০ নভেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, পাবর্ত্যবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি। বরং নতুন যেসব অভিধা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়, কিছু ক্ষেত্রে হাস্যকরও বটে।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার যে চেষ্টা, সেটা কতটা ব্যাকরণসম্মত বা নৃগোষ্ঠীর তাত্ত্বিক ভিত্তিতে কতটা যুক্তিসংগত?

পার্বত্য চুক্তির ফলে পার্বত্যবাসীর মধ্যে যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল, সেটা ভেঙে চুরমার করতে ষড়যন্ত্র চলছে বলেও অভিযোগ করেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, সম্প্রতি কেএনএফের নামে পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে সংঘাতের সৃষ্টি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ একদিকে সর্প হয়ে দংশন করছে, আরেক দিকে ওঝা হয়ে ঝাড়ছে। এভাবেই পার্বত্য সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

মানবেন্দ্র লারমা আত্মনিয়ন্ত্রণের যে দাবি তুলে ধরেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক জানিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিটি অস্বীকৃত রয়ে গেছে।

চারুকলার বকুলতলায় অনুষ্ঠান মঞ্চের পাশে ছিল এম এন লারমার প্রতিকৃতি। এই প্রতিকৃতির সামনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সূচনা সংগীতের পর এম এন লারমার জীবনী পাঠ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা। স্বাগত বক্তব্য দেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজিন। আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রমুখ। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানস্থলে এম এন লারমার স্মরণে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। এরপর সংগীত পরিবেশন করে গানের দল ‘মাদল’। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস।

অনুষ্ঠানে বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, মানবেন্দ্র লারমার আন্দোলনের স্বীকৃতি ও ধারাবাহিকতা হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি। এই চুক্তির কিছুটা বাস্তবায়ন হয়ে এখন একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। এটি আশঙ্কার। চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক এবং বহু ভাষার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় প্রতিষ্ঠা হবে না।