বিশেষ প্রতিবেদক: রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল-অবরোধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর। অবরোধের প্রথম দিন মঙ্গলবার রাজধানীর বিদ্যালয়গুলো খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম।

এই পরিস্থিতিতে কিছু বিদ্যালয়ে ক্লাস হয়েছে, কিছু বিদ্যালয়ে হয়নি। অনেক অভিভাবক সহিংসতার আশঙ্কায় সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাননি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, শিক্ষায় এখনই হয়তো বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি। কিন্তু সামনে ‘সংঘাতময় পরিস্থিতি’ দীর্ঘ হলে তার বড় প্রভাব পড়বে। এলোমেলো হয়ে যেতে পারে শিক্ষাপঞ্জি।

বিএনপি গত রোববার সারা দেশে হরতাল পালন করে। একই দিনে হরতাল ডেকেছিল জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দিনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল। হরতালের কারণে রাজধানীতে প্রায় কোনো বিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি সেদিন। হরতালের এক দিন পর থেকে টানা তিন দিনের অবরোধ শুরু করেছে বিএনপি। জামায়াতও একই কর্মসূচি পালন করছে।

মঙ্গলবার দুপুরের পর রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় অবস্থিত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে গেলে কয়েকজন শিক্ষক জানালেন শিক্ষকেরা উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিল না। অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী এলেও তারাও ফিরে গেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম প্রথম আলোর কাছে দাবি করলেন, সকালে যেসব শিক্ষার্থী এসেছিল, তাদের ক্লাস হয়েছে। তবে শিক্ষার্থী কম ছিল। এদিন সকালে অভিভাবকদের সঙ্গে সভাও করেছেন বলে জানালেন তিনি।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, যারা এসেছে তাদের ক্লাস হচ্ছে, তবে উপস্থিতি কম। হয়তো দুইটা শাখার ছাত্রীদের একত্র করে ক্লাস হয়েছে।

অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্রগুলো কমবেশি একই রকমের।

ইংরেজি মাধ্যমের কোনো কোনো বিদ্যালয় সশরীর ক্লাসের পরিবর্তে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। লিটল জুয়েলস নার্সারি স্কুল ইনফ্যান্ট অ্যান্ড জুনিয়র স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর বাবা জানালেন, তাঁর সন্তানের অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। তবে স্কুলে সশরীর যতটা ক্লাস হয়, ততটা হয়নি।

পরীক্ষার কী হবে
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন শিক্ষাবর্ষের শেষ পর্যায় চলছে। এ মাস থেকে বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হবে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পরীক্ষাগুলো অনিশ্চয়তায় পড়বে।

সাধারণত অন্যান্য বছর বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক পরীক্ষা হতো ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন নভেম্বর মাসেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা বিভাগ। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রম ৫ নভেম্বর শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু গতকাল সিদ্ধান্ত হয়, ৮ নভেম্বর পর্যন্ত মাধ্যমিকে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে। তাই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হবে ৯ নভেম্বর থেকে।

অষ্টম ও নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাও হবে নভেম্বর মাসে। অবশ্য বার্ষিক পরীক্ষাগুলো বিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হয়ে থাকে। ফলে বার্ষিক পরীক্ষা সারা দেশে একই তারিখে হয় না।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের রুটিন দায়িত্বে থাকা কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরীর সঙ্গে গতকাল কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ঘোষিত সময়েই বার্ষিক পরীক্ষা ও সামষ্টিক মূল্যায়ন নেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে। তবে এরপর পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী হয়তো নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 

এর আগে গত সোমবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরীক্ষা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, রোববার হরতাল ছিল, এদিন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। অনেকগুলো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অনেক অসুবিধা হয়েছে।

অবরোধের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন পরীক্ষার সময়, মূল্যায়নের সময়। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এসব পরীক্ষা-মূল্যায়ন শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কারও শিক্ষাজীবনকে জিম্মি করে এই ধরনের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। সেই ক্ষতির প্রভাব এখনো আছে। এখন রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে সেই ক্ষতির প্রভাব নতুন মাত্রায় আসতে পারে বলে আশঙ্কা করেন কোনো কোনো শিক্ষাবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে শিক্ষাসূচিতে তার প্রভাব পড়বে। তাই বলব, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়, এমন কোনো কিছু করা উচিত নয়। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা থেকে উতরানোর মতো নমনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। করোনাকালীন অনলাইন, অ্যাসাইনমেন্টসহ বিভিন্নভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি আছে।’