পর্যটন নগরে রেলসংযোগ, নতুন দিনের আশা

নতুন রেলপথ ঠিকঠাক আছে কি না, তা জানতে রোববার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে ট্রায়াল রান হয়। সেদিন কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনে হর্ষধ্বনিতে ট্রেনকে স্বাগত জানান সমবেতরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: পর্যটন নগরে রেলসংযোগ, নতুন দিনের আশাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের যে আইকনিক রেলস্টেশন নিয়ে বেশকিছু দিন ধরে আলোচনা চলছে, সেই স্টেশন থেকেই নবনির্মিত রেলপথটি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে শনিবার। পূরণ হতে চলেছে পর্যটকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেলপথের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।

এ রেলসংযোগ সমুদ্র নগরীর যোগাযোগ, পর্যটন এবং কৃষি ও মৎস্য খাতে নতুন দুয়ার খুলে দেবে বলে মনে করছেন কক্সবাজারের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

তারা এও বলছেন, কক্সবাজার জেলাকে ঘিরে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে এ রেলপথ সংযুক্ত হলে তা ভবিষ্যতে শিল্প-বিনিয়োগ এবং আমদানি-রপ্তানি খাতে বড় ভূমিকা রাখবে।

শনিবার বেলা ১১টায় কক্সবাজারের ঝিলংজায় আইকনিক রেল স্টেশনে আসবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ ও রেল স্টেশন উদ্বোধনের পর মতবিনিময় সভায় অংশ নেবেন।

এরপর বেলা ১টায় আইকনিক স্টেশন থেকে রামুর উদ্দেশে ছেড়ে যাবে প্রথম ট্রেন। লাল-সবুজ সেই ট্রেনে চড়েই রামু যাবেন সরকারপ্রধান।

রেলপথে খুলবে ‘সম্ভাবনার দুয়ার’
উদ্বোধন উপলক্ষে এখন কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন ঘিরে সাজ সাজ রব। ব্যানার আর ফেস্টুনে সেজেছে আশপাশের সড়ক। স্টেশনে বর্ণিল আলোকসজ্জা। আলোর সঙ্গে রঙ বদলাচ্ছে ফোয়ারায় স্থাপিত ঝিনুক।

কেবল দৃষ্টিনন্দন রেল স্টেশন আর প্রথম ট্রেন দেখাই নয়, কক্সবাজারের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখছেন এই রেল অবকাঠামোকে ঘিরে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশনারি অ্যাপ্রোচের রিফ্লেকশন। আজকের দিনে অর্থনীতি নির্ভর করে কানেক্টিভিটির উপর। এই রেলপথ দেশের ৪৫টি জেলার সাথে কক্সবাজারকে সংযুক্ত করল। কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে। গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে। আমরা একটা মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশনের যুগে প্রবেশ করছি।

এ রেলপথ সমুদ্র শহর কক্সবাজারের পর্যটন খাতকে অনেকটা এগিয়ে নেবে আশা প্রকাশ করে খোকা বলেন, ট্যুরিজম সেক্টর অন্য মাত্রায় উন্নীত হবে। পর্যটকরা আইকনিক স্টেশনেই তারকামানের হোটেলের সুযোগ সুবিধা পাবেন। এছাড়া কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং অভ্যন্তরীণ সড়ক পরিবহন ব্যবসাও অনেক বেড়ে যাবে। পাশাপাশি কক্সবাজার জেলায় উৎপাদিত লবণ ও আহরিত মাছ সারাদেশে কম খরচে বাধাহীনভাবে পৌঁছে যাবে। দেশের সব প্রান্ত থেকে সহজে পণ্য আসবে কক্সবাজারে।

কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু তাহেরও মনে করেন, এই রেলপথ পর্যটন ও যোগাযোগ খাতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

তিনি বলেন, পর্যটনের অনেক প্রসার হবে। শুধু শীত মৌসুমে নয়, বর্ষাসহ সারা বছরই পর্যটকরা আসবেন। ট্রেনের কারণে পর্যটকদের খরচ অনেক কমবে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সংযোগ স্থাপনে ভবিষ্যতে এই রেলপথ হবে ইন্টারন্যাশনাল রেল হাব।”

ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, কক্সবাজার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত; রেল যোগাযোগ হওয়ায় তা পর্যটন শিল্প বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখবে। বিমানে বা সড়ক পথে যাতায়াত খরচ বেশি হওয়ায় অনেকের ইচ্ছা থাকলেও নিয়মিত কক্সবাজার আসতে পারেন না। সেই বাধা আর থাকল না। স্বল্প খরচে পর্যটকরা সৈকতে বেড়ানোর স্বাদ পাবেন। আশা করছি, বছরে পাঁচগুণ বেশি পর্যটক আসবে। এতে রেলপথ ভূমিকা রাখবে। পর্যটন বিকাশে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় এইখাতের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই।

কক্সবাজার জেলায় প্রচুর লবণ, চিংড়িসহ বিভিন্ন রকম মাছ ও সবজি চাষ হয় জানিয়ে সাংবাদিক আবু তাহের বলেন, রেলের কারণে এসব পণ্য পরিবহন সহজ হবে তাতে করে কৃষক ও উদ্যোক্তারা সারাদেশে পণ্য পাঠাতে পারবে। অর্থনীতিতে এই রেল যোগাযোগ সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। বৃহত্তর কক্সবাজারে যে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেখানে এই যোগাযোগ অবকাঠামো ভূমিকা রাখবে।

ভবিষ্যতে এই রেলপথ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।  

রেল যোগাযোগে কক্সবাজার জেলা যুক্ত হওয়ার পুরো সুফল পেতে কিছু প্রস্তুতির কথা বলছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।

তিনি বলেন, ইকোনমিক জোনগুলোর সাথে এই রেললাইনের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা মার্কেট ডিমান্ড এনালাইসিস করে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিলে কক্সবাজার হয়ে উঠতে পারে একটি নতুন শিল্পাঞ্চল। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে বহু গুণ। সেই সুযোগ প্রধানমন্ত্রী সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এখন প্রয়োজন খাত সংশ্লিষ্টদের সঠিক প্রস্তুতি ও উদ্যোগ। আর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই রেলপথ ও আইকনিক স্টেশনসহ পুরো যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা। সেটার জন্য কমিউনিটির ওনারশিপ ধারণা গড়ে ওঠাও জরুরি। সার্বিকভাবে এই রেলপথ বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি বলতে পারি।

উদ্বোধন হবে আরো ১৯ প্রকল্প
শনিবার কক্সবাজার সফরে রেললাইন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন ও প্রথম টার্মিনালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন এ তিনটিসহ মোট ১৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন শেখ হাসিনা।

এর মধ্যে আছে- কক্সবাজার বিমান বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাঁকখালী নদীর উপর সেতু ও অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, ২১২ একর ভূমি ভরাট, ৪ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার স্লোপ প্রটেকশন বাঁধ নির্মাণ, সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ডিজাইন ও স্থাপনাকরণ প্রকল্প এবং গোরকঘাটা-শাপলাপুর সড়ক প্রসস্তকরণ।

পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তকরণ প্রকল্পও উদ্বোধন করবেন তিনি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) নির্মাণ প্রকল্পটিও আছে উদ্বোধনের তালিকায়।

এছাড়া কৈয়ারবিল থেকে চৌকিদারপাড়া পর্যন্ত সিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা পৌর বাস টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ এবং জাহানারা ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ইউনুছখালী নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, রত্না পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এবং মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হবে।

টেকনাফ উপজেলার মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার রিসিলেন্ট শেল্টার কাম আইসোলেশন সেন্টার, রামুর জোয়ারিনালা ইউনিয়নের মহসীনা বাজার ভায়া নন্দখালী সড়কে আর্চ ও আরসিসি গার্ডার ব্রিজ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে কাব স্কাউটিং সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

শনিবার বেলা ৩টায় তিনি মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরে পৌঁছাবেন। সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন এবং গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন।

এরপর বিকালে মাতারবাড়ী টাউনশিপ মাঠে মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দেবেন। জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।