জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধের একটি অন্যতম উপায় হলো টিকা | ছবি: সংগৃহীত

নাজনীন আখতার, ঢাকা: সিদরাতুল মুনতাহা বন্ধুদের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল টিকা নেওয়ার জন্য। এই টিকা দিলে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ হবে, এটা সে জানে। মা–বাবা আর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেছে। তাই ‘একটু একটু ভয়’ লাগলেও টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সে আগ্রহী।

কিশোরী সিদরাতুল রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। মঙ্গলবার স্কুলটিতে দ্বিতীয় দিনের মতো পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা দেওয়া হয়।

জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে গত ২ অক্টোবর থেকে সরকার বিনা মূল্যে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু করেছে। গত সোমবার (৩০ অক্টোবর) পর্যন্ত গত ২৯ দিনে ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৪৩৫ কিশোরী এই টিকা নিয়েছে।

টিকা নেওয়ার জন্য https://vaxepi.gov.bd/registration ওয়েবসাইটে গিয়ে ১৭ ডিজিটের অনলাইন জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়েছে। এরপর টিকা কার্ড ডাউনলোড করে নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে টিকা দিতে পেরেছে তারা। এখন পর্যন্ত টিকার জন্য ১২ লাখ ৫১ হাজার ১৬৬ কিশোরী নিবন্ধন করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) এই টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মেয়েশিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে এক ডোজ করে টিকা পাবে। প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিভাগে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে টিকা দেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে না, এমন কিশোরীরাও এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে।

কিশোরীরা স্কুলে ও ইপিআইয়ের টিকাদান কেন্দ্রগুলো থেকে টিকা নিতে পারছে।
দেশের ১ কোটির বেশি কিশোরীকে এ টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য সরকারের। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) প্রথম দফায় বাংলাদেশকে ২৩ লাখ টিকা দিয়েছে।

রাজধানীর বিদ্যালয়গুলোতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো টিকাদানকারীদের মাধ্যমে এই টিকা দিচ্ছে। সোমবার ও মঙ্গলবার তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জন্য টিকা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা ছিল।

উত্তর সিটি করপোরেশনের টিকাদানকারী ফিরোজা আক্তার মঙ্গলবার বলেন, প্রথম ৩৫ মিনিটে ৪৬ জন কিশোরীকে টিকা দেওয়া হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে। স্কুলের ১ হাজার ২০০ কিশোরীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। সোমবার ৫০৬ কিশোরীকে টিকা দেওয়া হয়।

তেজগাঁও বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক রৌশন আরা বেগম বলেন, সরকারের এই উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। তবে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে টিকা দেওয়ার পাশাপাশি মাসিকের সময় মেয়েরা যেন প্যাড ব্যবহার করতে পারে, সে বিষয়টিও দেখা দরকার। কিন্তু মেয়েকে প্যাড কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই অনেক পরিবারের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সর্বশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন। আর বছরে মারা যান ৪ হাজার ৯৭১ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে ঘন সাদা স্রাব, অতিরিক্ত রক্তস্রাব ও অনিয়মিত রক্তস্রাব। অল্প বয়সে বিয়ে, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, অপুষ্টি, একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন মেলামেশা থেকে জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অধীন ‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার পরীক্ষা কর্মসূচির’ প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা বলেছিলেন, কিশোরীদের টিকা দিলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ হতে পারে। তবে সম্পূর্ণ ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরীদের ৩০ বছরের বেশি বয়সের পর অবশ্যই ভায়া (জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্ণয়ের পদ্ধতি) পরীক্ষা করা উচিত।

এ ছাড়া ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদেরও ভায়া পরীক্ষা করা উচিত। কারণ, ভায়া পরীক্ষার মাধ্যমে একজন নারীর জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা ১০ বছর আগে শনাক্ত করা সম্ভব। ফলে আগেভাগেই শনাক্ত ও দ্রুত চিকিৎসা শুরুর মাধ্যমে ক্যানসার নির্মূল সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।