জরিপে অংশ নেন ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৫ হাজার ৬০৯ তরুণ–তরুণী। ফাইল ছবি |
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের উন্নয়নে এবং শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন দেশের প্রায় ৮৯ শতাংশ তরুণ। তাঁদের মতে, গত পাঁচ বছরে দেশে শান্তি ও ন্যায়বিচার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছেন দুই–তৃতীয়াংশ তরুণ। আর প্রায় ৭২ শতাংশ তরুণ বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না তাঁরা।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘দেশ আমার, দায়িত্বও আমার’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ১৫ দিন ধরে পরিচালিত এই জরিপে অংশ নেন ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৫ হাজার ৬০৯ জন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশির ভাগ তরুণ মনে করেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। তরুণদের আগ্রহ বেশি সরকারি চাকরিতে। তাঁদের মতে, পেশাগত দক্ষতার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষকদের মান বাড়ানোর। ৪২ শতাংশ তরুণ বিদেশে চলে যেতে চেয়েছেন। এর পেছনে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন তাঁরা। তবে দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান হলে বেশির ভাগই বিদেশ থেকে ফিরে আসতে চান বলে জানিয়েছেন।
জরিপের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি পাঁচ বছরে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিওয়াইএলসি এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করে থাকে। এ বছর বিওয়াইএলসি যৌথভাবে সিপিজের সঙ্গে জরিপটি করেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরার জন্য তরুণদের নিয়ে এ জরিপ করা হয়। এ বছরও তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোন কোন বিষয় তাঁদের জীবনে প্রভাব ফেলে, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা কতটুকু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাঁদের ধারণা কী এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন—এমন সব বিষয়ে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জরিপে তরুণদের যে মতামত উঠে এসেছে, তা অবাক করার মতো নয়। দেশ মানবাধিকার সংরক্ষণ ও সুশাসন থেকে পিছিয়ে পড়ছে। একক কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। ভোটাধিকার, বাক্স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। এসব নিয়ে জনমনে যেসব অসন্তোষ রয়েছে, সেই বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে তরুণদের মধ্যেও। তরুণেরা সরকারি চাকরি করতে চাইছেন, যাতে তাঁরা ছড়ি ঘোরাতে পারেন। আর তা না হলে দেশ থেকে চলে যেতে চাইছেন। এই প্রবণতা ভয়ংকর। এতে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাবে। এ অবস্থা রোধে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার জরুরি।
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৫৫ শতাংশ মনে করেন, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ দেশ নয়। প্রায় ৮৯ শতাংশ মনে করেন, দেশে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এ ছাড়া ৬৭ শতাংশের বেশি তরুণ বেকারত্বকে, প্রায় ৫১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটকে, ৪৭ শতাংশ নিরাপত্তাকে এবং ২৯ শতাংশ তরুণ গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষয়ে যাওয়াকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন। গত পাঁচ বছরে দেশের শান্তি পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন ৬৩ শতাংশ তরুণ। ৫৭ শতাংশের বেশি তরুণের মতে ন্যায়বিচার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৮ শতাংশের বেশি পুরুষ এবং প্রায় ২২ শতাংশ নারী। জরিপে শহরের তরুণেরাই বেশি অংশ নিয়েছেন। এর হার প্রায় ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রায় ২৫ শতাংশ গ্রামাঞ্চল ও প্রায় ১৫ শতাংশ শহরতলির তরুণেরা অংশ নেন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অংশগ্রহণকারী ছিলেন ঢাকা বিভাগের। এর হার ৩১ শতাংশের বেশি।
আগ্রহ বেশি সরকারি চাকরিতে
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হওয়ার চেয়ে বেতনভুক্ত চাকরিতে তরুণদের আগ্রহ বেশি। এর ওপর আবার বেশি আগ্রহ সরকারি চাকরিতে। জরিপ অনুসারে, পেশা হিসেবে উদ্যোক্তা হতে চান প্রায় ৪৯ শতাংশ। চাকরি করতে চান ৫১ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সরকারি চাকরি করতে চান ৬২ শতাংশের বেশি। আর বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতে চান ২৪ শতাংশের বেশি তরুণ।
প্রতিবেদনে তরুণদের পেশাগত অবস্থা তুলে ধরে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৩৮ শতাংশ তরুণ এখন পড়ছেন বা কোনো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তবে চাকরি খুঁজছেন না। ৩০ শতাংশের বেশি তরুণ পড়ছেন ও চাকরি খুঁজছেন। প্রায় ৪ শতাংশ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ও চাকরি খুঁজছেন। এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ সময় চাকরি করছেন ৯ শতাংশের বেশি। খণ্ডকালীন চাকরি করছেন ৩ শতাংশের বেশি। প্রায় ৩ শতাংশ পূর্ণাঙ্গ বা খণ্ডকালীন স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত। ১২ শতাংশ তরুণ বেকার।
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের মধ্যে ৭৭ শতাংশের বেশি মনে করেন, সামনের বছরগুলোতে তাঁদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আশাবাদী। প্রায় সমসংখ্যক ৬৯ ও ৭০ শতাংশ তরুণ বলেছেন, চাকরি করার জন্য ও উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য তাঁদের প্রস্তুত করতে শিক্ষাব্যবস্থার আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানের পাঠ্যক্রম তাঁদের দক্ষতা নিশ্চিত করছে না। যেসব ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি দরকার, সেগুলো হলো শিক্ষকের মান বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব সৃষ্টি, যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণ দক্ষতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি এবং গঠনমূলক চিন্তাভাবনা করা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শারীরিক ও মানসিক চাপ
স্বাস্থ্য বিষয়ে জরিপে অংশ নেওয়া তরুণেরা জানিয়েছেন, পারিপার্শ্বিক নানা কারণে তাঁরা শারীরিক ও মানসিক চাপ বোধ করেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক প্রায় ৬২ শতাংশ মনে করেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চাপে রয়েছেন। ৪৫ শতাংশ তরুণ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ৪০ শতাংশের বেশি তরুণ চাকরির অনিশ্চয়তা, প্রায় ৩২ শতাংশ তরুণ পড়াশোনার চাপ এবং ৩৩ শতাংশ সামাজিক প্রত্যাশার চাপের কথা বলেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবের মুখে পড়তে হয়েছে ৭৩ শতাংশের বেশি তরুণকে। নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত গরম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাস্থ্য সমস্যা, বায়ুর মান খারাপ হওয়া এবং খাবার ও পানির ঘাটতি।
অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশ চলে যেতে চান
তরুণদের ৪২ শতাংশের বেশি বলেছেন, তাঁরা বিদেশে চলে যেতে চান। বিদেশে চলে যাওয়ার পেছনে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন বেশির ভাগ। এই হার প্রায় ৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া প্রায় ৫১ শতাংশ তরুণ দক্ষতা অনুসারে অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ উদ্যোক্তা হওয়ার পথে নতুন কিছুর অভাব, ৪২ শতাংশের বেশি তরুণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা এবং প্রায় ৩৪ শতাংশ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকার কারণে বিদেশে চলে যেতে চান বলে জানিয়েছেন। এসব সমস্যার সমাধান হলে দেশে ফিরতে চান বলে জানিয়েছেন প্রায় ৮৬ শতাংশ তরুণ।
বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের প্রায় ৫৯ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য পান। এ ছাড়া পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টেলিভিশনে প্রচারিত খবর, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য পান। যে তথ্য পান, তা থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায় ৫৭ শতাংশ তরুণ আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।
তরুণদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তরুণদের মতামতে বাস্তবতার যে প্রতিফলন ঘটেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। দুর্নীতি, অনিয়ম, সুশাসনের ঘাটতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পুরো প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। তরুণদের ওপর সেই প্রভাব আরও বেশি পড়ে। কারণ, তরুণেরা সচেতন। তাঁদের চোখে বাংলাদেশের যে স্বপ্ন, তা হচ্ছে সম–অধিকার, সমতা আর মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুর্নীতি এসব কিছুর পরিপন্থী। তাই দুর্নীতিকে তরুণেরা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার ও অংশীজন—যাঁদের হাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে, তাঁরা তরুণদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে জরিপের সুফল পাওয়া যাবে। তরুণেরা নতুন ভোটার। তাঁদের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রত্যাশা ও ভোট না দিতে পারার যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা অশনিসংকেত। এই অনাস্থা তাঁদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়াচ্ছে। তাঁদের যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষণ না দেখে তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন।