পোশাক শিল্প কারখানা | ফাইল ছবি |
শুভংকর কর্মকার: তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়লেও মালিকদের ততটা বাড়াতে হবে না। মালিকদের বাড়াতে হবে কার্যত ৩৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
কারণ, ২০১৮ সালে মজুরিকাঠামো ঘোষণার পর প্রতিবছরই শ্রমিকদের মজুরি ৫ শতাংশ বেড়েছে। সঙ্গে কিছুটা বেড়েছে বাড়িভাড়া ভাতা। সেটা মজুরিকাঠামোতেই বলা ছিল।
হিসাব করে দেখা গেছে, বছর বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিলে নতুন কাঠামোতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়বে ৩ হাজার ১৫৫ টাকা। নতুন কাঠামোয় ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। এর ওপরের চারটি ধাপে (গ্রেড) প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ।
বিষয়টি নিয়ে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, তাত্ত্বিকভাবে হিসাব করলে হয়তো মজুরি বৃদ্ধির এই হার দাঁড়াবে। কিন্তু কোনো শ্রমিকই সর্বনিম্ন গ্রেডে তিন-চার বছর থাকেন না। তিনি আরও বলেন, রপ্তানি হওয়া একটি পোশাকের এফওবি (জাহাজীকরণ পর্যন্ত) মূল্যের ১২ থেকে ১৪ শতাংশ ব্যয় হয় শ্রমিকের মজুরির পেছনে। মজুরি যদি প্রকৃতপক্ষে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে ক্রেতাদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৬ শতাংশ বাড়তি দাম নিতে হবে। বর্তমান মন্দা বাজারে এটি খুবই কঠিন কাজ।
ফজলুল হক বলেন, ‘শ্রমিকদের চাহিদার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, যে মজুরি চূড়ান্ত হয়েছে, সেটি দিতে অধিকাংশ কারখানাই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বে।’
পোশাকশ্রমিকদের মজুরিকাঠামোতে গ্রেড থাকে সাতটি। নতুন কাঠামোতে সেটি কমিয়ে পাঁচটি করা হয়েছে। এ দাবি ছিল শ্রমিকপক্ষের। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওপরের গ্রেডগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির হার কিছুটা কম।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন ৫১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এবার ৫৪ শতাংশ করা হয়েছে। এক গ্রেড থেকে অন্য গ্রেডে মজুরির পার্থক্য গতবার ছিল ৫ শতাংশের কিছু বেশি। এবার সেটি কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এতে কারখানার মোট খরচের মধ্যে মজুরি বৃদ্ধিজনিত ব্যয় ২০১৮ সালের তুলনায় কম হবে।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় গত মঙ্গলবার পোশাকশ্রমিকের মজুরিকাঠামোর খসড়া চূড়ান্ত হয়।
মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমান মজুরিকাঠামোর প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেড বাতিল হচ্ছে। তৃতীয় গ্রেডের সিনিয়র (জ্যেষ্ঠ) অপারেটররা নতুন কাঠামোতে প্রথম গ্রেডে থাকবেন। এই গ্রেডের মোট মজুরি ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা হবে। দ্বিতীয় গ্রেডে (অপারেটর) ১৪ হাজার ১৫০, তৃতীয় গ্রেডে (জুনিয়র অপারেটর) ১৩ হাজার ৫৫০ এবং চতুর্থ গ্রেডে (সাধারণ অপারেটর) ১৩ হাজার ২৫ টাকা হবে মোট মজুরি।
পোশাক কারখানায় মোট শ্রমিকের মধ্যে ২-৩ শতাংশ থাকেন হেলপার বা সহকারী অপারেটর। সিনিয়র অপারেটর ও অপারেটররা হলেন কারখানার সেলাই বিভাগের সবচেয়ে দক্ষ কর্মী। বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, অথচ তাঁদের মজুরি প্রকৃতপক্ষে কম বেড়েছে। এই জন্যই দক্ষ শ্রমিকেরা সন্তুষ্ট নন।
এদিকে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকার কিছু কম। তখনকার ন্যূনতম মজুরি মার্কিন ডলারে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ৯৫ ডলারের কিছু বেশি।
বিগত এক বছরে ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে রপ্তানিকারকেরা প্রতি ডলারে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন। নতুন মজুরিকাঠামোর সাড়ে ১২ হাজার টাকা এখন ১১৩ ডলারের সমান। মার্কিন ডলারের বিবেচনায় শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ১৮ ডলারের মতো।
নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষণার পর গতকাল গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে এক নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
রাতে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এক বিজ্ঞপ্তিতে আজ বৃহস্পতিবার থেকে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, কোনো কারখানার শ্রমিকেরা কাজ না করলে, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে গেলে মালিকেরা ‘কাজ নেই, মজুরি নেই’ ভিত্তিতে কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যখন পোশাকশ্রমিকদের নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়িত হয়, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ শতাংশের কম। এখন তা ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। গত মাস অক্টোবরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এক কেজি মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩০ টাকা, যা এখন ৪৮ টাকা। ৮৬ টাকা লিটারের সয়াবিন তেল এখন ১৪৫ টাকা, ৫৫ টাকা কেজির মসুর ডাল ১০৫ টাকা, ২৫ টাকা কেজির আলু ৪৫ টাকা, ৩২ টাকা হালির ডিম এখন ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়।
সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। ন্যূনতম মজুরি যৌক্তিক ভাবে নির্ধারিত না হলে শ্রম অসন্তোষ অব্যাহত থাকার আশঙ্কা থাকবে।