ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বামী রুবেল ইসলামের মাথায় পানি ঢালছেন স্ত্রী আয়েশা খাতুন। রাজশাহীর চারঘাট উপেজলা স্বাস্ব্য কমেপ্লেক্সে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: রাজশাহীতে চারঘাট উপজেলা ডেঙ্গুর ‘হটস্পটে’ পরিণত হয়েছে। চারঘাটের মুংলী গ্রামেই স্কুলছাত্রসহ পাঁচজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছেন মানুষ। দরিদ্র পরিবারের লোকজন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শুধু ‘নাপা’ বড়ি খেয়েই বাড়িতে পড়ে থাকছেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৯০ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে ৫৮ জনই চারঘাটের রোগী। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাঘা উপজেলা—রোগী ছিলেন ৪২ জন। গতকাল শুক্রবার হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯৫, যা এ মৌসুমে সর্বোচ্চ। আজও চারঘাট ও বাঘার রোগীই সবচেয়ে বেশি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাজশাহীর নয়টি উপজেলার রোগীসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মুমূর্ষু রোগীদের অনেকে চিকিৎসা নিতে আসেন। গত ৮ জুলাই হাসপাতালে মৌসুমের প্রথম ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়। এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া ১৫ জন রোগীর মধ্যে এক গ্রামের পাঁচজনসহ শুধু চারঘাটের আছেন ছয়জন। ১৮ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর দিক থেকে জেলার মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে আছে চারঘাট ও বাঘা।
গত বৃহস্পতিবার চারঘাটের মুংলী বাজার থেকে আলতাবের মোড়ে যাওয়ার সময় কথা হয় ভ্যানচালক নজরুল ইসলামের (৫০) সঙ্গে। ডেঙ্গু জ্বরের কথা শুনে বললেন, চারঘাটের সব বাড়িতে জ্বর। তিনি নিজেই ১৫ দিন জ্বরে ভুগেছেন। তাঁর ছেলে স্কুলছাত্র রবিউল ইসলাম ও স্ত্রী রওশান আরা (৩৩) জ্বরে আক্রান্ত। ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা করানির সামর্থ্য নাই। শুধু নাপা বড়ির ওপর ভর কইরি আছি। যত দিন বাঁচি।’
ফেরার পথে আরেক ভ্যানচালক রুহুল আমিন (৪০) একই কথা বললেন। তিনি নিজে, স্ত্রী রীপা বেগম (৩০) ও ছেলে রায়হান (১৭) ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছেন। তিনি বলেন, ছেলে ও স্ত্রীর পরীক্ষা করিয়েছেন। তাঁদের দুজনেরই ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্রত্যেকের তিনটা করে পরীক্ষা করতে হয়েছে। তাতে একেকজনের ১ হাজার ৭০০ টাকা করে খরচ হয়েছে। এ জন্য নিজের আর পরীক্ষা করাতে পারেননি। জ্বর নিয়েই ভ্যান চালাচ্ছেন।
গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বৃহস্পতিবার মুংলী দক্ষিণ পাড়ার আজিত উল্লাহর স্ত্রী আশরাফুন (৭৫) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিছুক্ষণ আগেই মুংলী মাদ্রাসা মাঠে তাঁর জানাজা হয়েছে। এ নিয়ে গ্রামে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগী মারা গেলেন। প্রথমে মারা যান মোরশেদ আলীর স্ত্রী মাবিয়া বেগম (৪০)। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর আতিক হাসান ওরফে তৌহিদ (১৩) নামের এক স্কুলছাত্র, আতিকের মৃত্যুর দুই দিন পর গ্রামের তোতাহারের ছেলে আলাল উদ্দিন (৩০) মারা যান। সপ্তাহখানেক আগে মারা যান গৃহবধূ মানুয়ারা খাতুন (৪০)।
বুধবার পর্যন্ত চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ও চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৮০। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২৬ জন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
স্কুলছাত্র আতিকের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, গ্রামের আলতাবের মোড়ের তিনজন লোক প্রথমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তার পর থেকে গ্রামে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ছেলের মাথাব্যথা ও জ্বরের কথা বলার পর আর দেরি করেননি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ছয় দিন পর ছেলে মারা যায়।
চারঘাটের গোপালপুর গ্রামে সাজিদ হোসেন নামের ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্র গত বুধবার মারা গেছে। মুংলী লাগোয়া অনুপমপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রাজু মঙ্গলবার থেকে চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। ভ্যানচালক নজরুল ইসলামের ছেলে একই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, বিছানা থেকে মুখ তুলে কথা বলার সামর্থ্য নেই রাজুর। জ্বরে কাতর রাজু ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেছে। হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নারের একটি শয্যায় চিকিৎসাধীন রুবেল ইসলামের স্ত্রী আয়েশা স্বামীর মাথায় পানি ঢালছেন। ওয়ার্ডের সব বিছানা মশারি দিয়ে ঢাকা। হাসপাতাল থেকে বের হতেই দেখা গেল, মিম নামের কলেজপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে মা জামেলা খাতুন হাসপাতালে ঢুকছেন। মেয়েটি ভ্যানের ওপরে কাঁথা মুড়ে পড়ে রয়েছে। হাসপাতালের চারদিকে জলাবদ্ধ পরিবেশ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, বাইরে থেকে আসা মানুষের কারণে চারঘাটে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ হয়তো ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছেন। এখন ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৮০। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২৬ জন রোগী। বেশি মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘হাইপো ভলিমিয়া সিনড্রোম’। জ্বর সারলেই রোগীরা ভাবছেন, তাঁরা সুস্থ হয়ে গেছেন। কিন্তু জ্বর ছাড়ার দুই-তিন দিন পর ওই সিনড্রোমের আশঙ্কা থাকে।
আশিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিট আছে। স্যালাইনও আছে। তবে প্রতিদিন প্লাটিলেট মাপতে হয়। এ জন্য ‘সেল কাউন্টার মেশিন’ লাগে, সেটি হাসপাতালে নেই। এই পরীক্ষা বাইরে করতে হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেলে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া মৌসুমের প্রথম রোগী ছিলেন বাঘার ঢাকাচন্দ্রগাঁতি গ্রামের পাপ্পু (২৩)। তিনি ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মা সেলিনা বেগম ছেলের শোকে অসুস্থ পড়েন। ৩ অক্টোবর তিনিও মারা যান। গতকাল বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ১১ জন ডেঙ্গু রোগীকে ভর্তি পাওয়া যায়।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মো. ফারুক বলেন, মানুষকে সচেতন হতে হবে। জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। বৃষ্টি না হলে কড়া রোদ উঠলেই এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমে যাবে। চারঘাট উপজেলার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ব্যাপারে তিনি বলেন, ওখানে নির্মাণকাজ চলছে। ওদের কেরোসিন ছিটাতে বলে এসেছেন।