মেলার একটি স্টলে পণ্য দেখছেন এক দর্শনার্থী। ঢাকা, ১৮ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: বম লাইফা ত্লা মাইলাই ফুকনাক দিং—এটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বম ভাষার একটি গানের লাইন। গানটি পরিবেশনের আগে শিল্পীদের একজন বললেন, ‘আপনারা ভাষা না বুঝলেও সুর দিয়ে গানের অর্থ অনুভব করুন।’ পরে জানা গেল, সুরেলা গানটি উদ্দীপনামূলক। ওই লাইনের অর্থ হচ্ছে, ‘বম জনগোষ্ঠী সামনের দিকে এগিয়ে চলো’।
আজ বুধবার ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত বাংলাদেশে আদিবাসী বৈচিত্র্য উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বান্দরবানের বম জনগোষ্ঠীর শিল্পীরা এসেছিলেন। গুলশানে অবস্থিত আমেরিকান ক্লাবে স্টল সাজিয়েছেন তাঁদের নিজেদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে।
এমন আরও আটটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা অনুষ্ঠানে নিজেদের ভাষার বই, পাহাড়ি খাবার, পোশাক, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, হস্তশিল্পের পসরা নিয়ে বসেছিলেন। অতিথিরা আগ্রহ নিয়ে সেসব জিনিস দেখেছেন, কিনেছেন ও খেয়েছেন। মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছে আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর ভাষার গান, নাচ ও বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশনা।
অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে এ ধরনের মেলার আয়োজন করেছে দূতাবাস। একসঙ্গে এত রং-বৈচিত্র্য দেখে তিনি আনন্দিত। এটা বাংলাদেশে বড় ধরনের বৈচিত্র্য থাকার বিষয়টির প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
অনুষ্ঠানে একে একে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরা নানা পরিবেশনার মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরেন। বান্দরবানের ম্রো সম্প্রদায়ের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন বাঁশির সুরে তুলে আনেন পাহাড়ি এক আবহ। লম্বা বাঁশের সেই বাঁশিকে তাঁরা বলেন ‘বাইয়া’। বম সম্প্রদায়ের গান, সাঁওতাল আর মণিপুরি নাচ উপভোগ করেন দেশি-বিদেশি অতিথিরা।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, বম, ওঁরাও, মণিপুরি, সাঁওতাল, লুসাই, ম্রো, কোচ, চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিভিন্ন স্টল দিয়েছেন। লুসাই স্টলে নিজেদের পোশাক ও সাজে সজ্জিত জোপারি নামের এক তরুণী বলেন, তাঁরা বান্দরবান থেকে এসেছেন। স্টলে রেখেছেন নিজেদের হাতে বোনো শাল, কম্বল, ওড়না।
এর পাশের স্টলটি ছিল আওয়ার গোল্ডেন আওয়ার নামের একটি প্রকাশনা সংস্থার। তারা চাকমা, মারমা, ককবরোক, ম্রোসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ঐতিহ্যবাহী বই প্রকাশ করেছে। এর প্রকাশক ও মারমা সম্প্রদায়ের অধ্যাপক মোং তিং নিউ বলেন, এই গল্পগুলো ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করে। দুই প্রজন্ম ধরে ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য ধরে রাখতেই বইগুলো প্রকাশ করা হয়েছে।
মেলায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা হয়। ঢাকা, ১৮ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের স্টলটিতে সাজানো ছিল থেরি (বাসন), ফালা (ছুরি), আপারি (তীর), পিলচুতেংগচ (কুড়াল) ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক মেলকি সেদেক হাসদা বলেন, তাঁরা দিনাজপুর থেকে এসেছেন। দেশেও তাঁদের ঐতিহ্য অনেকের কাছে পরিচিত নয়। এখানে প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়ে বিদেশিদের সামনে নিজেদের ঐতিহ্য, সেই সঙ্গে ভূমি নিয়ে লড়াই ও নিপীড়নের কথা তুলে ধরেছেন তাঁরা।
মেলকি সেদেক হাসদা আক্ষেপ করে বলেন, তাঁদের ভূমির সবই এখন বেদখল। যেই ভূমি নিজেদের ছিল, সেখানেই এখন তাঁদের কামলা খাটতে হয়। জাতীয় সংসদে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আসন সংরক্ষণে তাঁদের দাবির কথা তুলে ধরেন তিনি।
সুফল চাকমা পড়াশোনা করেছেন চিত্রাঙ্কন নিয়ে। তাঁর আদং স্টলে ছিল সেই ছাপ। বিভিন্ন ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন। কাঠের একই ফ্রেমে তিনটি পুতুল দেখিয়ে বললেন, এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীশক্তি ও ঐক্য বুঝিয়েছেন। পোশাক দেখে চেনা যায় পুতুল তিনটি চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের নারীর প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশে আদিবাসী বৈচিত্র্য উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ঢাকা, ১৮ অক্টোবর | ছবি: মার্কিন দূতাবাসের সৌজন্যে |
মেলায় আরেকটি আয়োজন ছিল প্যানেল আলোচনা। এই আলোচনায় পিটার হাস বলেন, সমাজে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অবদানের কথা মনে রাখতে হবে। তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মানবাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মানবাধিকারের জন্য বিশ্বজুড়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালের আগে আদিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ছিল লজ্জার। নিজ দেশেই সেখানের আদিবাসীরা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ চলছে এখন।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী এবং ‘গ্লোবাল অ্যান্টি-রেসিজম চ্যাম্পিয়নশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ জয়ী রানি ইয়েন ইয়েন বলেন, যেকোনো দেশের জন্য বৈচিত্র্য হচ্ছে সম্পদ। সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে এই বৈচিত্র্য উদ্যাপন করা যাবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনায় আরও অংশ নেন সঞ্জীব দ্রং, অধ্যাপক মোং তিং নিউ ও আংচেইন মারমা মিল্টন।