মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কেন সব সময় নিপীড়কের পক্ষে

হামাসের হামলার পর ইসরায়েল সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন | ছবি: রয়টার্স

ডোনাল্ড আর্ল কলিন্স: ১৮ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই উড়ে গিয়েছিলেন ইসরায়েলে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তাতে সমর্থন দিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর দুই নেতাই সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁদের বক্তব্য পরিষ্কার। ফিলিস্তিনিরা ‘অমানুষ’ এবং এই জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে যে সহিংসতা চলছে তা যুক্তিযুক্ত।  

নেতানিয়াহু বলেন, সভ্য বিশ্ব যেভাবে নাৎসি ও আইসিসকে পরাজিত করতে এক জোট হয়েছিল, ঠিক সেভাবে হামাসের বিরুদ্ধেও তাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। আর প্রেসিডেন্ট বাইডেন মন্তব্য করেন, হামাসের অন্যায় ও সহিংসতা দেখে মনে হয়েছে আইসিসও তাদের চেয়ে বিবেচক ছিল।

বাইডেনের এই সফর এবং তাঁর যে ভাষ্য তা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে তুলে ধরে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সব সময় নিপীড়কের পক্ষে। বিশ্বের ঘৃণ্য সব সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার ব্যাপারে নির্দলীয় এই শাসনব্যবস্থার সবাই এককাট্টা।    

যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা বরাবর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নমূলক নীতির সমর্থক। হোক তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে কিংবা বাইরে। যদিও তাঁরা মুখে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের তুবড়ি ছোটায়।  
যুক্তরাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক চরিত্র এবং গণহত্যার কথা বিবেচনা করলে ইসরায়েলের প্রতি তাদের এই সমর্থনে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।

মধ্য-ডানপন্থীরা ইসরায়েলের এই অ্যাপারথেইড (জাতিগত বৈষম্যমূলক আচরণ), দখল, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জায়নিজমের প্রসার ঘটানো নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়।

ধারাবাহিকভাবে যত মধ্য-ডানপন্থী নেতারা যুক্তরাষ্ট্রে সরকার গঠন করেছেন, তাঁদের সবাই ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ কথা বলে বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহযোগিতা দিয়েছেন। এর শুরু হয়েছে সেই ১৯৭১ সালে।

এই ইতিহাস কিংবা বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ কখনো ছিল না, এখনো নেই। কারণ, গাজায় প্রাণহানির সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে এবং ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ১৯৪৮ সালে নাকবার পর এত বড়সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুতি আর ঘটেনি। এমনকি ৭৫ বছর ধরে ইসরায়েলের নিরাপত্তার নামে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা, ইসরায়েলকে আরব-শূন্য করে দেওয়ার চেষ্টা, প্রত্যেক আরবকে সন্ত্রাসী, জঙ্গি বা ইহুদি বিদ্বেষী বলা—ঐতিহাসিকভাবে এসবই ঘটে চলেছে।

হ্যারি এস ট্রুম্যান থেকে শুরু করে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের ‘প্রকৃত কর্তৃপক্ষ’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন। যদিও ১৯৩০ এবং ৪০-এর দশকে জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা সহিংসতা করেছে, যাকে মার্কিনরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করেছে। তারা ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশদের খেদিয়ে দিয়েছে, স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে গুন্ডামি করেছে।  

ট্রুম্যান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে যাওয়ার ঠিক ১১ মিনিট পর।

আমি একাধারে মার্কিন নাগরিক, হিব্রু ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের সাবেক সদস্য ও কৃষ্ণাঙ্গ অর্থোডক্স ইহুদি। আমরা মনে করি প্রাচীন ইসরায়েল থেকে হারিয়ে যাওয়া ১০টি গোত্রের একটি হলাম আমরা। আমার পক্ষে ইতিহাসটা হজম করা কঠিন ছিল।

একজন ‘ধার্মিক’ ইহুদি হিসেবে আমি আমার শ্বেতাঙ্গ ভাইবোনদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে ইসরায়েলিরা মধ্যপ্রাচ্যে একটি আধুনিক আবাসভূমি গড়ে তুলেছে।  

ইহুদি ধর্মানুসারীদের মতো টুপি পরা কিংবা পাসওভারের রাতে ঐতিহ্যবাহী খাওয়াদাওয়া আমার ভালো লাগত না। কিন্তু আমি কয়টা জিনিস শিখেছিলাম, তার একটি ছিল ‘এল চাইম’, বা জীবনের উদ্‌যাপন।

যখন আমি কলেজে গেলাম এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাউথ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বৈষম্য ও অবিচার নিয়ে খোঁজখবর করতে শুরু করলাম, তখন আমি ধাক্কা খেলাম। ‘জীবনের উদ্‌যাপনে’ যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা কী করে নিপীড়িত মানুষের মানবাধিকারকে অস্বীকার করতে পারেন?

১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অহিংস নাগরিক আন্দোলন, দক্ষিণ আফ্রিকায় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের গণ-অভ্যুত্থান, ’৫০ ও ’৮০-এর দশকে অ্যাপারথেইড ও সহিংস নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—এসবই হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসা জাতিগত বৈষম্য এবং সহিংস নিপীড়নের অবসান ঘটাতে।  

একই কথা প্রযোজ্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামের ক্ষেত্রেও। হোক সেটা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও), যাদের নেতৃত্বে ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকের সহিংস বা ২০০০ সালের অহিংস ‘বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংশন’ আন্দোলন হয়েছে।

যারা এই আন্দোলনকে নিন্দা করে, তারা আসলে ‘জীবনের উদ্‌যাপনের’ যে ধারণা তাকেই অস্বীকার করে।

আমাদের কংগ্রেসম্যান রিপ্রেজেনটেটিভ জ্যায়মি রাসকিন আমাকে ও তাঁর নির্বাচনী এলাকার অন্যান্যদের ইসরায়েলের ওপর বর্বর হামলা সম্পর্কে ই-মেইল করেছেন। রাসকিনের অফিস ওই অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছে। এই সহযোগিতা তাদের জন্য, যারা ইসরায়েল ছাড়তে চায়, গাজা নয়।  

দৃশ্যত, শোকসন্তপ্ত ফিলিস্তিনি ও আরব-আমেরিকান সম্প্রদায়ের মানুষের তাদের প্রতিনিধি বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সমর্থনের কোনো প্রয়োজন নেই।  

এই কর্মকাণ্ডগুলো মধ্য–ডানপন্থী বা চরম-ডানপন্থী মার্কিন সমাজের মনোভাবের প্রকাশ ।  

গত সপ্তাহে এনপিআর/পিবিএস নিউজআওয়ার/ম্যারিস্ট ইউনিভার্সিটির জনমত জরিপে দেখা গেছে সিংহভাগ মার্কিন গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলার পক্ষে। স্বল্পসংখ্যক মানুষ ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

মার্কিন নাগরিকদের একটি অংশ বন্দুক-বিরতি চায়, গাজায় ইসরায়েলি হামলার অবসান চায়। কিন্তু তারা সংখ্যালঘু। কেন্দ্র-দক্ষিণপন্থী বা কেন্দ্র-বামপন্থী ঘরানার এই মানুষগুলো আপাতত রক্তপাত হানাহানি বন্ধ হলেই সন্তুষ্ট।

ইসরায়েল একটি অ্যাপারথেইড রাষ্ট্র, যার নীতি ঔপনিবেশিকতা ও গণহত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই ফিলিস্তিনকে দখলমুক্ত করতে সহযোগিতা করা উচিত, এমন ধারণা পোষণ করা জনগোষ্ঠীটি খুবই ছোট। পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বলছে এই হার মাত্র ৫ শতাংশ।

১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকা ইস্যুতে যেমনটি হয়েছিল, ফিলিস্তিন ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থীরা পশ্চিমাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে পারে, যেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল, ইসরায়েলি ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে, অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

 হয়তো তখনই জায়নিজম ‘জীবনের উদ্‌যাপন’ কী, তা অনুধাবন করবে। 

ডোনাল্ড আর্ল কলিন্স লয়োলা ইউনিভার্সিটি, ম্যারিল্যান্ডের আফ্রো আমেরিকান ইতিহাসের শিক্ষক।

আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ।