আফগানিস্তানের বিপক্ষে এমন হাস্যোজ্জ্বল বাংলাদেশকে দেখা গেছে একটু পরপরই | ছবি: এএফপি

উৎপল শুভ্র: বিশ্বকাপের শুরুটা কেমন চেয়েছিল বাংলাদেশ দল? উত্তরটা খুবই সহজ। অবশ্যই জয় দিয়ে শুরু করতে। সব দলেরই তো এটাই চাওয়া থাকে। তাই বলে এমন জয়? একটু সন্দেহ হয়। আট বছর আগের বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল আফগানিস্তান। ২০১৫ বিশ্বকাপের ফিকশ্চার চূড়ান্ত হওয়ার দিন থেকেই একটু অস্বস্তির চোরকাঁটা বিঁধছিল মনে। এবার হয়তো আরেকটু বেশিই।

দুই দলের সর্বশেষ ম্যাচে বাংলাদেশের দাপুটে জয় আছে, কিন্তু আরেকটু পেছনে গেলেই যে দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে পরাজয়। তার ওপর বিশ্বকাপের জন্য দেশ ছাড়ার আগে পুরো দেশ কাঁপিয়ে তোলা অমন তুলকালাম বিতর্ক। এর সঙ্গে বিশ্বকাপের মতো এত বড় একটা টুর্নামেন্টে শুরুর নার্ভাসনেস যোগ করুন। এবার সত্যি বলুন তো, এতটা কি আপনিও ভেবেছিলেন?

ভেবেছিলেন, দুই ইনিংস মিলিয়ে বরাদ্দ ১০০ ওভারের বদলে ৭২ ওভারেই শেষ হয়ে যাবে খেলা! এমন হেসেখেলে জয় আসবে যে, বলতে গেলে ম্যাচের কখনোই তা নিয়ে সংশয় থাকবে না। শুরুর কিছুক্ষণকে অবশ্য এর বাইরে রাখতে হয়। কিছুক্ষণ বলতে না হয় ধরুন আফগানিস্তান ইনিংসের প্রথম ২৪/২৫ ওভার।

লিখেই মনে হলো, ২৫তম ওভারে আফগানিস্তান যখন ২ উইকেটে ১১২, সাকিব আল হাসান তখন কী ভাবছিলেন? টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, এই মাঠে চেজ করা দল ভালো করে। তা তখন কত রান চেজ করতে হতে পারে বলে অনুমান করছিলেন বাংলাদেশ-অধিনায়ক!

১৫৬ অবশ্যই নয়। সাকিবকে জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজনই দেখছি না। ইনিংসের মাঝপথেই স্কোরবোর্ডে ১১২, তার ওপর উইকেটে আছেন আফগানিস্তান দলের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান রহমানউল্লাহ গুরবাজ। কাল বিশ্বকাপ-অভিষেকের আগে ২৬ ওয়ানডেতেই যাঁর ৫টি সেঞ্চুরি। সর্বশেষ দুটি আবার ১৪৫ ও ১৫১ রানের। এই দুই সেঞ্চুরির প্রথমটি বাংলাদেশের বিপক্ষেই, এই গত জুলাইয়ে চট্টগ্রামে খেলা যে ইনিংসে ছিল ৮টি ছক্কা। এদিনও মোস্তাফিজের বলে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কাটা তখনই ম্যাচের সেরা শটের দাবি জানিয়ে রেখেছে।

এই যখন অবস্থা, ইনিংসের প্রায় এক–চতুর্থাংশ বাকি থাকতেই আফগানিস্তানকে ১৫৬ রানে গুটিয়ে দেওয়ার কথা সাকিব তখন কিভাবে ভাববেন! তার ওপর বিশ্বকাপেই যেখানে এত কম রানে কোনো দলকে শেষ করে দেওয়ার ইতিহাস নেই বাংলাদেশের (২০০৭ বিশ্বকাপে বারমুডার ৯ উইকেটে ৯৪ হিসাব থেকে বাদ, কারণ বৃষ্টি সেটিকে বানিয়ে দিয়েছিল ২১ ওভারের ম্যাচ)।

বাংলাদেশের জন্য ২০২৩ বিশ্বকাপের শুরুটা তাই নতুন ইতিহাস গড়েই। সেটিও কী নাটকীয়ভাবে! ২ উইকেটে ১১২ রানের অস্বস্তি আফগানিস্তান চোখের পলকে রূপান্তরিত ৪ উইকেটে ১১২-এর স্বস্তিতে! স্বস্তিটা আরও বেশি চতুর্থ উইকেটটা গুরবাজের বলে। আউট হয়েছেন মোস্তাফিজের স্লোয়ারে। তবে শুধু এটুকু বললে হাশমতউল্লাহ শহীদির ‌‘অবদান’কে খাটো করে দেখা হয়! রানের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা আফগান অধিনায়কই তো গুরবাজের ওপর চাপটা এমন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

শুধু এটাই বললে আবার ইনিংসের মাঝখানে সাকিব আর মিরাজ যে বোলিংটা করেছেন, সেটিকে খাটো করা হয়। প্রথমে বোলিং করার কারণ হিসেবে সাকিব এই মাঠে পরে তাড়া করে জয়ের রেকর্ডের কথা বলেছেন বটে, তবে আসল কারণ বোধ হয় অন্য। ধর্মশালার উইকেট ঐতিহ্যগতভাবে পেসারদেরই বেশি ভালোবাসে, তার ওপর এই ম্যাচটা শুরু সকাল সাড়ে ১০টায়। দুই দলের সর্বশেষ চার ওয়ানডেতে ২-২ সমতা থাকার পরও বাংলাদেশ এখানে একটু হলেও ফেবারিট ছিল এ কারণেই। স্পিন-শক্তিতে আফগানিস্তানই হয়তো একটু এগিয়ে। তবে পেস আক্রমণে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখায় ওই হয়তো-টয়তো বলার কোনো প্রয়োজনই নেই। টসে জিতলে সাকিব যে সাতসকালে সেই তুরুপের তাস ব্যবহার করতে চাইবেন, এটা তো জানাই ছিল।

যদিও ম্যাচ একটু এগোনোর পরই দেখা গেল, এখানেও তুরুপের তাস অধিনায়ক নিজেই। সপ্তম ওভারেই বল হাতে তুলে নিয়েছেন। আফগানিস্তানের প্রথম ২টি উইকেটও তাঁর। অধিনায়ক নিজেই যখন দলের সেরা বোলারদের একজন, নিজেকে কখন কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা অধিনায়কত্বের বড় একটা আর্ট। সেটিতেও সাকিবের লেটার মার্কস। উইকেট পেয়েও সরে গেছেন আক্রমণ থেকে। আবার ফিরেছেন, যখন তাঁকে আসলেই প্রয়োজন।

এদিন বাংলাদেশ দলের সেরা বোলারের স্বীকৃতি পেতে অবশ্য মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে সাকিবকে জোর লড়াই করতে হবে। আফগান ব্যাটসম্যানদের বজ্র আঁটুনিতে বেঁধে ফেলার কৃতিত্বটা তো এই অফ স্পিনারেরই। প্রথম ওভারে ৯ রান দিয়ে ফেলার পর পরের ৫ ওভারের দুটিই মেডেন। দ্বিতীয় মেডেনটিতে আবার উইকেটও আছে। ৯ ওভারে ২৫ রানে ৩ উইকেটই তাঁকে ম্যাচ-সেরার দাবিদার করে তুলেছিল। পরে ব্যাটিংয়ে যা করেছেন, তাতে তা আরও প্রশ্নাতীত হয়ে গেছে। এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওপেনিং করতে নেমে সেঞ্চুরি করেছিলেন, এদিন তিনে নেমে ৫৭।

১৬ রানে নতুন জীবন পেয়েছেন। ফজলহক ফারুকির বলে পয়েন্টে নজিবউল্লাহ জাদরান যে ক্যাচটা ফেলেছেন, এই পর্যায়ের ক্রিকেটে তা খুব কমই পড়ে। এটা যেমন সত্যি, আবার এটাও সত্যি যে, মিড অফে রহমত শাহর যে ক্যাচটা মিরাজকে ড্রেসিংরুমে ফিরিয়েছে, তেমন ক্যাচও প্রতিদিন দেখা যায় না। বিশ্বকাপ শেষেও যা হয়তো সেরা ক্যাচের তালিকায় থাকবে।

ততক্ষণে অবশ্য কাজের কাজ করে ফেলেছেন মিরাজ। ব্যাটিংয়ে কিছু করে সাকিবও যে ম্যাচ-সেরার দাবি তুলবেন, তার কোনো সুযোগই নেই। বাংলাদেশের জিততে আর ৩৪ রান লাগে তখন। কথাটা অবশ্য একটু আপত্তিকরই হলো, মিরাজ তো আর ম্যাচ-সেরার পুরস্কার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ব্যাটিং করেননি। করেছেন দলকে জেতানোর জন্য। আফগানিস্তানের ইনিংসের পরই তা একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সত্যি, তবে একটা মৃদু হলেও একটা কাঁপুনি কিন্তু লেগেছিল। মিরাজ কখন ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন, মনে আছে তো? তানজিদ হাসানের ওই অকারণ রান আউটের সময় স্কোরবোর্ডে রান মাত্র ১৯। লিটন একটু বেরিয়ে গিয়ে ফারুকির বল স্টাম্পে টেনে আনার সময় আর মাত্র ৮ রানই যোগ হয়েছে বাংলাদেশের স্কোরে। ২ উইকেটে ২৭ যথেষ্টই অস্বস্তিকর, জাদরান ওই ক্যাচটা না ফেললে তা হয়ে যেত ৩ উইকেটে ৩৮।

বোলাররা কাজের কাজটা এমনভাবেই করে দিয়েছেন যে, আপনি বলতেই পারেন, তা হলেই বা কী হতো! এত কম রান, বাংলাদেশই তো জিতত। হয়তো জিতত, হয়তো...। এসব ‌‘হয়তো’ মুছে দিয়েছে নাজমুল হাসানের সঙ্গে মিরাজের ৯৭ রানের জুটি। যে জুটি ভাঙার পরও গ্যালারিতে উৎসব করছে বাংলাদেশের সমর্থকেরা। জয়ের আগাম উৎসব।

নাহ্, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শুরুটা এর চেয়ে ভালো হতে পারত না! স্বপ্নের মতো শুরু? সমস্যা কী, এটা তো বলতেই পারেন।