রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কমলাপুর বিলে বৃষ্টিতে ভেসে গেছে আড়াই হাজার বিঘার মাছের খামার। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিলে মাছ ধরতে মানুষের ঢল অব্যাহত রয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কমলাপুর বিলে মোয়াজ্জেম হোসেনের ১২০ বিঘার পুকুর রয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে মাছ ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি ২৫ জন কর্মচারী নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিলে যান। অপেক্ষাকৃত নিচের পুকুর থেকে মাছ ধরে ওপরের পুকুরে আনছিলেন। একসময় এমন ঢল নামে যে তাঁরা ভেসে যেতে থাকেন। তাঁরা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ গিয়ে স্থানীয় লোকজন নিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে। একজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুকুরের মাছও সব ভেসে যেতে থাকে। এতে মোয়াজ্জেম হোসেন পাগলপ্রায় হয়ে যান।
এর পরের গল্পটা অন্যরকম। পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পেয়ে মাছ ধরতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। গোদাগাড়ীর প্রেমতলীর এক ব্যক্তিই ধরেছেন ১০ মণ মাছ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকে আজ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কমলাপুর বিলে মানুষের ঢল অব্যাহত রয়েছে। ফেসবুকে এই দৃশ্য দেখে রাজশাহী শহর থেকে সস্তায় মাছ কিনতে ভিড় জমিয়েছেন মানুষ। আজ সারা দিন কমলাপুর বিলে রীতিমতো মাছের মেলা বসেছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরুণ কুমার মণ্ডল বলেন, গোদাগাড়ীর ভূমির গঠন একটু আলাদা। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। কমলাপুর ও পলাশবাড়ি এলাকাটা একটু নিচে। চারদিকের পানি এই এলাকা দিয়ে নেমে বারোনই নদীতে গিয়ে পড়ে। ঢলের পানি এই দিক দিয়ে এমনভাবে নেমে এসেছে যে ওই বিলের সব পুকুর ভেসে গেছে। বিলে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার বিঘা এলাকায় শতাধিক পুকুর রয়েছে। এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো হিসাব করা হয়নি। শনিবার বিকেলে গিয়ে এর হিসাব করে একটি প্রতিবেদন দেবেন।
খামারিদের আহাজারির মাঝে মাছ ধরার উৎসবে মেতেছেন লোকজন। শুক্রবার বিকেলে কমলাপুর বিলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, বিলে ঢলের পানিতে মানুষ ভেসে যাচ্ছে, এই খবর পেয়ে তাঁরা বিলে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় লোকজনই ডুবন্ত মানুষকে টেনে তুলেছেন। পুলিশ সহযোগিতা করেছে। সেই সময় মাছচাষিরা বলছিলেন যে তাঁদের দলে ২৬ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মকসেদ আলী (৫৫) নামের একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা গ্রামে। কিন্তু আজ সারা দিনে তাঁকে পাওয়া যায়নি, মর্মে পুলিশকে কেউ নিশ্চিত করেননি।
মাছ ভেসে যাওয়া ও কর্মচারী নিখোঁজের ব্যাপারে কথা বলতে মোয়াজ্জেম হোসেনের যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিখোঁজ মকসেদ আলীর এক স্বজন মজিবর রহমান বলেন, আজ সারা দিন বিলে আত্মীয়–স্বজনরা মকসেদের খোঁজ করেছেন। পানির স্রোত যেদিন দিয়ে গেছে, এ রকম বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল দিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। এরপরও মকসেদের সন্ধান পাননি তাঁরা।
আজ বিকেলে ওই বিলে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ। যত মানুষ পানিতে, তত মানুষ বিলের ধারে। কেউ পানিতে নেমে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। কেউ মাছ নিয়ে আসছেন। অনেকে বস্তায় মাছ ভরে টেনে নিয়ে আসছেন। অনেকেই বরফ দিয়ে মাছ প্যাকেটে সংরক্ষণ করছেন। আর সেই সঙ্গে চলছে কেনাবেচার ধুম। উপজেলার প্রেমতলীর আকবর আলী (৫০) ফাঁস জাল দিয়ে ১০ মণ মাছ ধরেছেন। তাঁর সঙ্গে তিনজন কর্মচারী ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সারা দিনে তিনি এই মাছ ধরেছেন।
কমলাপুর বিলে বৃষ্টিতে ভেসে গেছে আড়াই হাজার বিঘার মাছের খামার। ফেসবুকে এই দৃশ্য দেখে রাজশাহী শহর থেকে সস্তায় মাছ কিনতে ভিড় জমিয়েছেন মানুষ। শুক্রবার বিকেলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ফেসবুকে পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর দেখে তানোরের মুন্ডুমালা এলাকা থেকে শাহ আলী (৪২) এসেছেন। খেপলা জাল দিয়ে তিনি বৃহস্পতিবার রাতে দুই মণ ও আজ সারা দিনে আরও এক মণ মাছ ধরেছেন। কমলাপুর গ্রামের মুকুল হোসেন (৪৫) খেপলা জাল দিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে এক মণ আর আজ সারা দিনে ২০ কেজি মাছ ধরেছেন। গোদাগাড়ীর কাজীহাটা গ্রামের পান্না (৫২) আজ সারা দিনে খেপলা জাল দিয়ে মণখানেক মাছ ধরেছেন।
দেখা যায়, বিলের ধারে সারি সারি মোটরসাইকেল রেখে মানুষ প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে বিলের ধারে গিয়ে মাছ কিনছেন। তিন থেকে চার কেজি ওজনের কাতলা মাছ ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি, ২ কেজি ওজনের রুই মাছ ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হযরত আলীর ওই বিলে ১০০ বিঘার পুকুর রয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর ১৬ বিঘার একটি পুকুর ছাড়া সব মাছ ভেসে গেছে। উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ঢলের পানি এই বিল দিয়ে নেমে যায়। ৪-৫ ফিট ওপর দিয়ে পানি নামছিল। পানির স্রোতের মুখে দাঁড়ানোর কোনো উপায় ছিল না। এই জন্য তিনি মাছের আশা করে বিলে লোক নামাতে যাননি। তাঁর ধারণা, এই বৃষ্টিতে বিলের প্রায় ১০০ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও বাগমারা উপজেলার প্রায় ৫০০ পুকুর ভেসে গেছে।